২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

সিলেটে বৃষ্টি আতঙ্ক বাড়ছে পানি

সড়কের পাশে বাঁশের তাঁবু বানিয়ে থাকছেন বানভাসি মানুষ
-

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি এখনো সামাল দিতে পারেনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সিলেট। বন্যার পানি ধীরে ধীরে নামলেও এখনো অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। এর মধ্যেই মঙ্গলবার সকাল থেকে থেমে থেমে সিলেটে বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে আবার বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে এ জেলায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, আগামী কয়েক দিন সিলেটে বৃষ্টি হতে পারে। ভারতে বৃষ্টি হলে সিলেটের দিকে পাহাড়ি ঢল নামবে। এতে আবারো পানি বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে। তবে মঙ্গলবার সকাল থেকে হওয়া বৃষ্টিতে জেলার নদ-নদীতে পানির উচ্চতা বাড়েনি বরং কিঙ্কুটা কমেছে।
সিলেটে মঙ্গলবার সকাল থেকে সূর্যের দেখা মেলেনি। থেমে থেমে হচ্ছে বৃষ্টি। বৃষ্টির কারণে সকালে নগরের বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ ছিল।
নগরের তালতলা এলাকার বাসিন্দা সালাউদ্দিন আহমদ বলেন, বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি পরিবার নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যান। দুই দিন আগে বাড়ি ফিরেছেন। তবে এখনো পানির কারণে কাজে যেতে পারছেন না। বাড়ি ফিরেও আয়-রোজগার না থাকায় সংসার চলছে না। এর মধ্যে ফের পানি বাড়লে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে যেতে হবে। সেখানে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হবে।
সিলেটে গত দেড় মাসের ব্যবধানে দুই দফা বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গত ১২ মে থেকে সিলেট শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছিল। সে দফায় প্রায় ১০ দিন পর পানি নেমে যায়; কিন্তু ১৪ জুন থেকে টানা বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ সারা দেশের সাথে সিলেটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলা প্রায় তিন দিন সারা দেশের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল। এমন অবস্থায় জরুরিভাবে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলে উদ্ধার তৎপরতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে অংশ নেয় বাহিনীটি। এর মধ্যে সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় পানি নামতে শুরু করেছে। তবে গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় বানভাসিদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে সোমবার সন্ধ্যা ৬টার তুলনায় মঙ্গলবার সকাল ৯টায় পানি দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ কমেছে। নদীর ওই অংশে সোমবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৯টার মধ্যে বৃষ্টি হয়েছে ৭ মিলিমিটার। নদীর সিলেট পয়েন্টে সোমবারের তুলনায় পানি কমেছে একই পরিমাণে। মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সিলেট পয়েন্টে পানি ছিল ১০ দশমিক ৬১ সেন্টিমিটার। সিলেট পয়েন্ট এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে ৬ মিলিমিটার।
কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে বিপদসীমা ১৫ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটার। সেখানে সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পানি ছিল ১৬ দশমিক ৮৫ সেন্টিমিটার। মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সেখানে পানি ছিল ১৬ দশমিক ৭৪ সেন্টিমিটার। নদীর শেওলা পয়েন্টে পানি বিপদসীমার দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে পানি ছিল ১৩ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার। নদীর শেরপুর পয়েন্টে পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১ দশমিক শূন্য ৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার সকাল ৯টায় ওই পয়েন্টে পানি ১০ দশমিক ৪৯ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া লুভা নদীর পানি লুভা পয়েন্টে ১৩ দশমিক ৫৮ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর বাইরে বেড়েছে লুভা, সারি নদী ও ধলাই নদের পানি। সারি নদীর সারিঘাট পয়েন্টে পানি সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১০ দশমিক ৩৭ সেন্টিমিটার থাকলেও মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সেটি বৃদ্ধ পেয়ে ১১ দশমিক ১২ সেন্টিমিটারে পৌঁছেছে। ধলাই নদীর ইসলামপুর পয়েন্টে পানি সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৯ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার থাকলেও মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সেটি ১০ দশমিক শূন্য ৩ সেন্টিমিটারে পৌঁছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, আগামী কয়েকদিন বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। এতে পানি বৃদ্ধি পাবে কি না, আগেই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু ভারতে বৃষ্টি হলে সিলেটে পাহাড়ি ঢল নামতে পারে। এতে ফের বন্যার শঙ্কা আছে।
সড়কের পাশে বাঁশের তাঁবু বানিয়ে থাকছেন বানভাসি মানুষ : এখনো পানির নিচে বিস্তীর্ণ এলাকা। ডুবে আছে সড়ক, ঘরবাড়ি। পানি ঘরে ওঠায় অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন আশ্রয়কেন্দ্রে। আর যাদের আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই হয়নি তারা আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন উঁচু সড়কে। সড়কের পাশেই ত্রিপল, পলিথিন আর বাঁশ দিয়ে তাঁবু তৈরি করা সেখানে বসবাস করছেন তারা। কোথাও কোথাও আবার নিজের ছাউনির ভেতরে গবাদিপশুরও বসবাস। শুধু সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কেই নয়, মূল সড়ক থেকে বিভিন্ন উপজেলামুখী সড়কেও এ চিত্র।
এখানে রয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট। পানি না কমায় অস্থায়ী আশ্রয় থেকে ঘরে ফিরতে পারছেন না এসব মানুষ। এ ছাড়া যেসব এলাকায় পানি কিছুটা নেমেছে সেখানেও শুরু হয়েছে নতুন দুর্ভোগ। পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। মহাসড়কে থাকায় তাদের অনেকে ত্রাণ দিচ্ছেন। এসব মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পানি না কমায় তারা বাড়িতে ফিরতে পারছেন না।
স্বপ্নের ফলানো ধান শুকাতে দিয়ে সড়কের পাশেই বসা ছিলেন আমির আলী। তিনি বললেন, বানের পানিতে তার ৬ মাসের খাবার পচে গলে নষ্ট হয়েছে। তবুও আশা ছাড়ছেন না তিনি। শুকাচ্ছেন মনের তাগিদে। এগুলোই যে তার একমাত্র সম্বল। তার সাফ কথা, দুর্গন্ধ ছড়াক তাতে কিছু যায় আসে না। খেয়ে বেঁচে থাকা তো যাবে। ধান শুকাতে দিয়ে সেগুলো নাড়ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ সমিরুন বেগম। বানের পানি কিভাবে তাকে আক্রমণ করল জানতে চাইলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ভাই আমাদের জীবনই তো কষ্ট দিয়ে গড়া। সুতরাং এগুলো আর গায়ে লাগে না। ক্ষুধা, কষ্ট এগুলো আমাদের কাছে তুচ্ছ। আক্ষেপের স্বরে এ প্রতিবেদককে বললেন, আর এসব কষ্ট বলে লাভ কি? আপনারা কি পারবেন কষ্ট দূর করতে।
একই সড়কে থাকছেন সমর আলী। পরিবার নিয়ে তিনি সড়কের পাশে আবাস গড়েছেন ৭ দিন ধরে। তার ঘরে এখনো হাঁটুপানি। তাই যাচ্ছেন না ঘরে। রোববার তিনি ঘরটি দেখেও এসেছেন। কিন্তু ঘর আর ঘরের জায়গায় নেই। ভিটেমাটি প্রায় ধ্বংসস্তূপ। পানি নেমে গেলে কিভাবে ঘর উঠাবেন সে চিন্তায় ঘুম নেই তার।
শুধু ছকিনা আর সমর আলীই নয়, এমন শত শত বানভাসির বাস এখন সড়কে ছাউনি টানিয়ে। কোনো হৃদয়বানের ত্রাণের গাড়ি এলে তাদের খাবার জুটে। নয়তো না খেয়েই ক্লান্ত শ্রান্ত দেহ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হয় অনিশ্চিত অন্ধকার দেখে দেখে।
দশ দিন ধরে পানিবন্দী রয়েছেন সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলাবাসী। পানিবন্দী মানুষের যা ত্রাণসামগ্রী দেয়া হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া মানুষের বাইরে আজিজপুর বাজারসহ বাজারের আশপাশে তাঁবু বানিয়ে আরো প্রায় দুই-আড়াইশ’ পরিবার গবাদিপশু নিয়ে একসাথে বসবাস করছেন।
সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলার চিত্রও প্রায় একই। ১৩ উপজেলার মধ্যে প্রায় সব ক’টি উপজেলার অধিকাংশ ডুবে আছে এখনো। বিশেষ করে বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাটের অসংখ্য গ্রাম এখনো পানিতে টইটুম্বুর। কিছু এলাকায় পানি অল্প কমলেও বেশির ভাগ এলাকায় অপরিবর্তিত রয়েছে। এসব এলাকায় বেসরকারি পর্যায়ে তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়।
সরকারি হিসাবে, সিলেট জেলায় বন্যায় চার লাখ ১৬ হাজার ৮৫১টি পরিবারের ২১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৫১ জন প্লাবিত হয়েছেন। এর বিপরীতে সরকার বরাদ্দ দিয়েছে এক হাজার ৪১২ টন চাল, ১৩ হাজার ২১৮ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং দুই কোটি ১৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ বানভাসিরা মাথাপিছু ৬৪৫ গ্রাম চাল বরাদ্দ পেয়েছে। অন্য দিকে একেকজন বানভাসির বিপরীতে প্রায় ১০ টাকা বরাদ্দ হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement
শাস্তি কমিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনে উদ্বেগ টিআইবির যখন দলকে আর সহযোগিতা করতে পারবো না তখন অবসরে যাব : মেসি ইভ্যালির রাসেল-শামীমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাহনেম্যান আর নেই বিএনপি নেতাকর্মীদের সম্পত্তি দখলের অভিযোগ খণ্ডালেন ওবায়দুল কাদের আটকের পর নাশকতা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলো ইউপি চেয়ারম্যানকে বদর যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন পণবন্দী জাহাজ ও ক্রুদের মুক্ত করার প্রচেষ্টায় অগ্রগতি হয়েছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঝালকাঠিতে নিখোঁজের ২ দিন পর নদীতে মিলল ভ্যানচালকের লাশ বাল্টিমোর সেতু ভেঙে নদীতে পড়া ট্রাক থেকে ২ জনের লাশ উদ্ধার যুক্তরাষ্ট্রে ছুরিকাঘাতে নিহত ৪

সকল