১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খাবার পানির সঙ্কটে সিলেটের বন্যার্তরা : সুনামগঞ্জে কাটা ধান নিয়ে দুর্ভোগে কৃষক

-

গ্রাম কিংবা শহর, দুর্ভোগের ধরন একই। কোথাও খাদ্য সঙ্কট, কোথাও শুধু বিশুদ্ধ পানির। এ অবস্থায় মানবেতর দিন পার করছেন বৃহত্তর সিলেটের মানুষ। পানিতে তলিয়ে থাকায় দুর্গত এলাকাগুলোয় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। সিলেট নগরীতে ওয়াসার পাম্পগুলোও তলিয়ে থাকায় পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এতে স্থানীয় লোকজন সুপেয় পানির সঙ্কটে পড়েছেন। অন্য দিকে সুনামগঞ্জে কাটা ধান শুকানো ও মাড়াই করার উপযুক্ত স্থান না পেয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন পুরো জেলার কৃষক।
সিলেট ব্যুরো থেকে এ টি এম তুরাব জানান, সিলেটে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ডিভিশন-৩-এর অধীনস্থ দক্ষিণ সুরমা এলাকাও বন্যাকবলিত। নগরের মেন্দিবাগ এলাকায় অবস্থিত সিটি করপোরেশনের পানি বিশুদ্ধকরণ (ওয়াটার ট্রিটমেন্ট) প্লান্টও তলিয়ে গেছে। পাশাপাশি আরো চারটি পাম্পও তলিয়ে যাওয়ায় পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ফলে এসব এলাকার মানুষও বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন না।
সিলেটের অন্তত ২০ উপজেলার শতাধিক গ্রাম বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। বিশুদ্ধ খাবার পানি সংগ্রহের একমাত্র ভরসা টিউবওয়েল তলিয়ে গেছে। ফলে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানকারী লোকজন দূর-দূরান্ত থেকে কলসি, হাঁড়ি-পাতিলে করে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন। এসব এলাকার গ্রামীণ জনপদে পানি ও খাবার সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন প্রান্তিক পর্যায়ের লোকজন। নিত্যদিনের উপার্জনে সংসার চালানো মানুষরা বন্যায় আটকে পড়ায় তাদের আয়-রোজগারে প্রভাব পড়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে রান্নার ব্যবস্থা নেই। শুকনো খাবারের পাশাপাশি তাদের রান্না করা খাবারো বেশি প্রয়োজন। শহর এলাকায় খাবার সমস্যা না থাকলেও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট প্রকট। নগরের বন্যাকবলিত এলাকার লোকজন বলছেন, কয়েকদিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। তার ওপর নেই পানি। খাবার বা টয়লেটের জন্য তারা ঠিকমতো পানি পাচ্ছেন না। নিম্ন আয়ের মানুষজন বৃষ্টির পানি ছেঁকে পানের জন্য ধরে রাখছেন। সিলেট নগরের মাছিমপুর এলাকার বাসিন্দা তুষার আহমদ মান্নার বাসার টিউবওয়েলটি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে খাবার পানির জন্য বৃষ্টির পানি জমিয়েছিলেন। সেগুলো কাপড়ে ছেঁকে পাত্রে রাখছেন। এরপর সেই পানি ফিটকিরি দিয়ে বিশুদ্ধ করে পান করবেন বলে তিনি জানান।
ভোগান্তিতে পড়েছে নগরের শাহজালাল উপশহর, শেখঘাট, কলাপাড়া, সোনারপাড়া, মেন্দিবাগ, মাছিমপুর, ছড়ারপার, চালিবন্দর কানিশাইল, মণিপুরি রাজবাড়ী, তালতলা, জামতলাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ। ওই এলাকার বাসিন্দারা জানান, এখনো অনেক ব্লকে কোমর সমান পানি, ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। পানির মোটর তলিয়ে গেছে, তাই পানি তুলতে পারছেন না। কিছু কিছু জায়গায় মোটর ঠিক থাকলেও ট্যাংকি ময়লায় নষ্ট হওয়ায় পানি তোলা যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে সিসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী (পানি) আবদুস সোবহান বলেন, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে ময়লা পানি ঢুকেছে। সেটি চালু করা যাচ্ছে না। সিসিক পানি সরবরাহের জন্য স্থাপন করা পাম্পগুলোও পানির নিচে। চারটি পাম্প বন্ধ হয়ে আছে। এ অবস্থায় দুই হাজার লিটারের ভ্রাম্যমাণ পানির ট্যাংক দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, বন্যাকবলিতদের পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন ও শুকনো খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রেও বিশুদ্ধ পানি থেকে শুরু করে রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।
ত্রাণের জন্য হাহাকার : এ দিকে সিলেটে ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতির। প্লাবিত সব এলাকা থেকেই নামতে শুরু করেছে পানি। প্রায় এক সপ্তাহের পানিবন্দী দুর্ভোগ শেষে গত শুক্রবার রাত থেকে কমতে শুরু করে পানি। গতকাল রোববারও কমেছে পানি। প্লাবিত অনেক অঞ্চল থেকেই এখন পানি নেমে গেছে। নগরীর বেশির ভাগ এলাকাই এখন পানিবন্দী পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়েছে। আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সিলেট পাউবো উপবিভাগীয় প্রকৌশলী এ কে এম নিলয় পাশা বলেন, বন্যা পরিস্থিতির আরো উন্নতি হয়েছে। পানি দ্রুত নেমে যেতে শুরু করেছে।
এ দিকে ত্রাণ নিয়ে বানভাসীদের হাহাকারও দেখা দিয়েছে অনেক জায়গায়। এখন পর্যন্ত ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করছেন অনেকে। এর মধ্যে শনিবার কোম্পানীগঞ্জে ত্রাণ নিয়ে দুর্গতদের মধ্যে কাড়াকাড়ি ও হট্টগোলের ঘটনা ঘটে। অন্য দিকে বন্যায় সিলেটে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে জানিয়ে সিলেটের সিভিল সার্জন ডা: এস এম শাহারিয়ার বলেন, ইতোমধ্যে শতাধিক লোক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। চর্মরোগও বাড়ছে। পানি কমলে রোগবালাই আরো বাড়তে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, পানিবাহিত রোগ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে এ জন্য আমরা এরই মধ্যে ১৪০টি মেডিক্যাল টিম গঠন করেছি।
ত্রাণের কোনো সঙ্কট নেই জানিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো: মজিবর রহমান বলেন, এ পর্যন্ত বন্যার্তদের মাঝে ৩২৫ মেট্রিক টন চাল, ১৫ লাখ টাকা ও সাড়ে ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জে কাটা ধান শুকাতে না পাড়ায় দুর্ভোগ
সুনামগঞ্জ থেকে তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ জানান, ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে দুই সপ্তাহ ধরে চলা বন্যা পরিস্থিতিতে নাকাল হয়ে পড়েছেন সুনামগঞ্জবাসী। রাস্তাঘাট ডুবে, বাসাবাড়িতে পানি প্রবেশ করায় মানুষ বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছেন। দিনে হঠাৎ রোদের ঝলকানি আর রাতে মুষলধারে বর্ষণ ও মুহুর্মুহু বজ্রপাতে শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন হাওরবাসী। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিভিন্ন উপজেলার হাওরের উঁচু জমির বোরো ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, ধর্মপাশা, মধ্যনগর উপজেলার শত শত একর জমির ধান তলিয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। বহু কৃষকের পাকা ধানি ক্ষেত চোখের সামনে তলিয়ে যাওয়া আর শ্রমিকের বাড়তি মজুরি কৃষকের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু ধান কাটায় একজন শ্রমিকের মজুরি দিতে হচ্ছে ৭-৮ শত টাকা করে। ওই শ্রমিক ধান কেটে দিয়েই তার দায় শেষ করছেন। ওই কাটা ধান জমির মালিককে ছোট নৌকা অথবা মাথায় করে নিরাপদ উঁচু স্থানে নিয়ে আসতে হচ্ছে। পানি বেড়ে যাওয়ায় উঁচু জমি যেমন তলিয়ে গেছে তেমনি ধান মাড়াই ও শুকানোর কাজে খলাও (উঁচু কান্দা) ডুবে যাচ্ছে। এ কারণে ধান মাড়াই ও শুকানোর জন্য বিভিন্ন উপজেলার মূল সড়ক ও গ্রামীণ সড়কগুলোতে তুলে তা রাখা হচ্ছে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে কাটা ধান স্তূপ করে রাখার ফলে ওই ধানে চারা গজিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকরা।
স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন, গত ৮-১০ বছরেও উঁচু জমির ধান এমনভাবে তলিয়ে যায়নি। বৈরী আবহাওয়ার কারণে ধান ও খড় (গোখাদ্য) শুকাতে পারছেন না তারা। সারা বছরের গোখাদ্য সঙ্কট নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়ছেন কৃষক। গতকাল সুনামগঞ্জে শহরতলির আশপাশে নদীর পানির উচ্চতা কিছুটা কমলেও হাওরে প্রতি দিন বাড়ছে পানি। ধর্মপাশার কৃষক নুরুল মিয়া জানান, তিনি ধারণাও করতে পারেননি উঁচু জমিতে এভাবে পানি উঠে যাবে। গত ১০-১২ বছরেও তিনি এমন পরিস্থিতি দেখেননি।

 


আরো সংবাদ



premium cement