২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নিয়োগ পরীক্ষায় এবার ডিজিটাল জালিয়াতি

১৫ লাখ টাকায় মাস্টার কার্ডে কানে উত্তর সরবরাহ
-

দেখতে অবিকল ব্যাংকের ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড। কিন্তু এ কার্ড দিয়ে ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা তোলা যায় না। আসলে এটি ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড নয়, ওই কার্ডের প্রলেপ দেয়া একটি বিশেষ ইলেকট্রনিক ডিভাইস। এ ডিভাইসের ভেতরে থাকে মোবাইল সিম। এর মাধ্যমে বাইরে থেকে আসা কল রিসিভ করা গেলেও কল করা যায় না। ডিভাইসটির সাথে আছে একটি ছোট্ট বল্টুর মতো ইয়ারপিন, যা কানে লাগিয়ে ওই ডিভাইসে আসা কল রিসিভ করে কথা বলা যায়। এসব ডিভাইস ব্যবহার করেই বিসিএস, মেডিক্যাল, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ও সরকারি ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি প্রার্থীকে পাস করিয়ে দেয় একটি চক্র। সম্প্রতি তিন পর্বে চলমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা ঘিরে তৎপর হয়ে ওঠে একটি সিন্ডিকেট।

র্যাবের গোয়েন্দারা জানান, কয়েকটি ভাগে চক্রটি এমন প্রতারণা চালাত। এক গ্রুপ নিয়োগ পরীক্ষাসংক্রান্ত খোঁজখবর নিত, অন্য গ্রুপ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারি বা বেসরকারি চাকরিপ্রত্যাশীদের খুঁজে বের করে ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় পাস করানোর নিশ্চয়তা দিয়ে অগ্রিম টাকা নিত। আরেক গ্রুপ পরীক্ষা কেন্দ্রের কোনো এক কর্মচারীকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে প্রশ্নপত্র ফাঁস করত। এভাবেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।

র্যাব জানায়, গত ২২ এপ্রিল প্রাথমিকের নিয়োগ পরীক্ষায় ১৬ জনকে এই ডিভাইসে উত্তর সরবরাহ করে এই চক্র। আজ শুক্রবার প্রাথমিকের নিয়োগ পরীক্ষায়ও এক ডজন ডিভাইস সরবরাহের চুক্তি হয় চাকরিপ্রার্থীদের সাথে। কিন্তু বিধিবাম তার আগেই তাদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেয় র্যাব। গত বুধবার দিবাগত রাতে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চক্রের চারজনকে গ্রেফতার করে র্যাব-২। তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু ডিভাইস ও বিভিন্ন আলামত জব্দ করা হয়।

গ্রেফতারকৃতরা হলো মূলহোতা ইকবাল হোসেন। অন্যরা হলোÑ আগারগাঁও সমাজসেবা অধিদফতরের কম্পিউটার অপারেটর নজরুল ইসলাম, মুজিবনগর সমাজসেবা কার্যালয়ের সাবেক সমাজকর্মী মোদাচ্ছের হোসেন এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করার পর এই চক্রে জড়িয়ে পড়া রমিজ উদ্দিন। ডিভাইসগুলো (হিডেন স্পাই ওয়্যারলেস কিট) পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন রমিজ। ইকবাল পেশায় স্কুলশিক্ষক। প্রশ্ন জালিয়াতি, প্রশ্নপত্রের সমাধানসহ বিভিন্ন প্রতারণার মাধ্যমে উপার্জন করেছেন তিনি বিপুল অর্থ। এসব অর্থের মাধ্যমে গড়েছেন বিলাসবহুল বাড়ি, কিনেছেন জমিজমাও। সরকারি বিভিন্ন দফতরের ব্যক্তিরা ইকবালের অবৈধ কর্মকাণ্ডের দোসর।
গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এই সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজন ডিভাইস জালিয়াতির মাধ্যমেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, এ চক্রের সাথে মেধাবী একদল শিক্ষার্থীও কাজ করত। ফাঁস করা প্রশ্ন সমাধান করে তারা ফোনের মাধ্যমে পৌঁছে দিত পরীক্ষার্থীদের।

জানা গেছে, প্রথমে চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন পরীক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ করে চুক্তি করত। চুক্তিকৃত অর্থের পরিমাণ ক্ষেত্র বিশেষে আড়াই লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত। পরীক্ষার নির্ধারিত দিনে চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের বাহুতে বিশেষ কায়দায় মাস্টার কার্ডসদৃশ ইলেকট্রনিক ডিভাইসটি স্থাপন করা হতো। এরপর কানে লাগিয়ে দিত অতিক্ষুদ্র ইয়ারপিন, যার মাধ্যমে পরীক্ষার্থী কেবল কল রিসিভ করতে পারবে। কোন কল দিতে পারবে না। পরীক্ষার্থী কেন্দ্রে ঢোকার পর বাইরে থেকে ডিভাইসটিতে ফোন করা হতো। পরীক্ষার্থী কৌশলে সেই কল রিসিভ করে প্রশ্ন জানিয়ে দেয় বাইরে থাকা এ চক্রের সদস্যদের। এরপর বাইরে থেকে ওই প্রশ্নের উত্তর দ্রুত বের করে ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের সরবরাহ করা হতো।

এ ব্যাপারে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সঙ্ঘবদ্ধ এ প্রতারক চক্রটি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করত। চক্রটি এ জন্য ‘হিডেন স্পাই ওয়্যারলেস কিট’ ব্যবহার করত। এভাবে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণের নিশ্চয়তা দিয়ে চাকরি প্রার্থী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে শর্তসাপেক্ষে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

তিনি বলেন, তারা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগ পরীক্ষা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। পরে ওই নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার স্থান ও পরীক্ষার গার্ড সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করত। চক্রের অন্য সদস্যরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারি বা বেসরকারি চাকরিপ্রত্যাশীদের খুঁজে বের করে ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় পাস ও চাকরি পাইয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখাত। এরপর চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে অগ্রিম দুই লাখ টাকা নেয়া হতো। হলে প্রবেশের সময় সুকৌশলে পরীক্ষার্থীকে দেয়া হতো ‘হিডেন স্পাই ওয়্যারলেস কিট’। এ ডিভাইসের মাধ্যমে বাইরে থেকে সরবরাহ করা হতো প্রশ্নপত্রের সমাধান।
তিনি জানান, প্রতারণায় ব্যবহার করা ডিজিটাল ডিভাইসগুলো বিদেশ থেকে আনা এবং মূলত দু’টি অংশে বিভক্ত। ডিভাইসটির একটি অংশ ইয়ারপিন, যা কানের ভেতরে দেয়া হয়। অটোমেটিক কল রিসিভ হওয়া সিম লাগানো অপর অংশটি শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে তাদেরকে পরীক্ষার হলে পাঠানো হয়। পরে পরীক্ষার্থীরা প্রশ্ন বাইরে পাঠাতেন। প্রতারক চক্রটি প্রশ্নপত্রের উত্তর দেয়ার জন্য আগে থেকেই মেধাবী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একটি টিম প্রস্তুত রাখত। ওই টিম উত্তর বলে দিত চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের।

জানা গেছে, মূল হোতা ইকবাল হোসেন ২০০৮ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৫ সালে একই এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী আলতাফ হোসেন নামে একজনের সাথে পরিচয়ের সূত্রে এই চক্রে জড়িয়ে যান ইকবাল। ২০২০ সালে করোনায় আলতাফ মারা যাওয়ার পর চক্রটি নিজেই পরিচালনা শুরু করেন ইকবাল। তিনি অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সিরাজগঞ্জে বিলাসবহুল পাঁচতলা বাড়ি করেছেন। তার বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা ও বেশ কয়েকটি সাধারণ ডায়েরি রয়েছে। র্যাব বলছে, গ্রেফতার রমিজ এই চক্রের অন্যতম দোসর। ২০২০ সালে ইকবালের সাথে পরিচয় সূত্রে এই চক্রে জড়ান। ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস সম্পর্কে তার ভালো অভিজ্ঞতা থাকায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পান। পরীক্ষার্থীদেরকে ডিজিটাল ডিভাইসগুলোতে সংযুক্ত করে বাইরে থেকে উত্তর সরবরাহ করত রমিজ।

এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আল মঈন বলেন, মোদাচ্ছের আর নজরুল মূলত পরীক্ষা কোন হলে অনুষ্ঠিত হবে, গার্ড কে থাকবে খোঁজখবর নিত। এরপর পরীক্ষা শুরুর পরপর কারো মাধ্যমে প্রশ্নের ছবি হোয়াটসঅ্যাপে তাদের কাছে চলে আসত। আমরা সেসব লোকজনের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। ২০২০ সাল থেকে ডিভাইসের মাধ্যমে নতুনপন্থায় চাকরি নিয়োগ পরীক্ষায় এই জালিয়াতি শুরু করে চক্রটি। তারা অনেক পরীক্ষার্থীর খোঁজ নেয়। আবার অনেক সময় যারা পরীক্ষায় অংশ নেয় তারাই তাদের কাছে যায়। গত ২২ এপ্রিল ১৬ জনকে এ প্রক্রিয়ায় উত্তর সরবরাহ করা হয়। আমরা তাদের বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছি।

এসব ডিভাইস পাশের দেশ ভারত থেকে এই অসৎ উদ্দেশ্যে তারা এনেছে জানিয়েছে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সাধারণত এ ধরনের ডিভাইস আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করেন। আমরাও এগুলো কিনতে চাইলে যথাযথ নিয়ম মেনে কিনে থাকি। এর বাইরে কেউ এসব ডিভাইস বিক্রি করছে কি না তাতে আমাদের নজরদারি অব্যাহত থাকবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement