২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পি কে হালদারকে ফেরত আনা নিয়ে অনিশ্চয়তা

সব মামলার অগ্রগতির তথ্য চেয়েছেন আদালত
-

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার হওয়া এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পি কে হালদার) বাংলাদেশে কবে ফেরত আনা যাবে তা সঠিক কেউই বলতে পারছেন না। তবে শিগগিরই তাকে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না।
ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) পি কে হালদারকে গ্রেফতার করেছে নাগরিকত্ব সনদ জালিয়াতি, অবৈধভাবে অবস্থানসহ একাধিক অপরাধের দায়ে। ফলে সেসব মামলার বিচার ও শাস্তি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে দেশে ফেরত আনার জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার, ঋণ জালিয়াতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যান পি কে হালদার। পরিচয় গোপন করে শিব শঙ্কর হালদার নামে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করছিলেন তিনি; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। গত ১৪ মে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোক নগরের একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন পি কে হালদার। তার পাঁচ সহযোগীকেও গ্রেফতার করে ইডি। তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে ভারতীয় রেশন কার্ড, ভারতীয় ভোটার আইডি কার্ড, প্যান এবং আধার কার্ডও সংগ্রহ করেছিলেন। পিকে হালদারের অন্য সহযোগীরাও ভারতীয় এসব কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে সংগ্রহ করেন।
ভারতের গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) অন্তত ২২টি মামলায় পি কে হালদারসহ তার সহযোগীদের অভিযুক্ত করতে যাচ্ছে। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী মামলার সংখ্যা কমতেও পারে। ইতোমধ্যে পি কে হালদারকে দুই দফায় রিমান্ডে নিয়েছে ভারতের তদন্ত সংস্থা। তিন দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল মঙ্গলবার তাকে আবারো ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, পি কে হালদারকে দেশে ফেরাতে হলে আপাতত অপেক্ষা করতে হবে ভারতের আদালতে তার সব ক’টি মামলার বিচার ও সাজা ঘোষণা পর্যন্ত। এর পরই বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় সাজার মেয়াদ বাংলাদেশের জেল হেফাজতে পূরণ করার শর্তে দেশে ফেরানো যেতে পারে পি কে হালদারসহ বাকি ছয় অভিযুক্তকে।
সূত্র জানায়, কোনো বন্দীকে ফেরত আনার ব্যাপারে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে যথাযথ মাধ্যমে সেই দেশের সরকারকে চিঠি দেয়। চিঠি পাওয়ার পর সেই দেশের সরকার বিবেচনা করবে। পরে বিনিময়ের মতো হলে তারা বন্দীকে ফেরত দেবে। পি কে হালদারের বিষয়ে অন্য কোনো জটিলতা না থাকলে আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিন মাসের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে পি কে হালদারকে গ্রেফতারের ব্যাপারে ভারতীয় সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারকে এখনো কিছু জানায়নি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, পি কে হালদার বাংলাদেশের মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তি। তিনি ভারতে গ্রেফতার হলেও অফিসিয়ালি বিষয়টি আমাদের এখনো জানানো হয়নি। তাকে ফিরিয়ে আনতে আইনিভাবে যা করা প্রয়োজন আমরা তা-ই করব। এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে কাগজপত্র পাওয়ার পর ফিরিয়ে আনতে আইনি চেষ্টা অব্যাহত রাখব। তিনি বলেন, পি কে হালদার যেখানে আছেন, সেখানকার আইনের মুখোমুখি হবেন কি না এসব বিষয় দেখার পর আমরাও তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত চাইব।
এ দিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, ভারতে আটক পি কে হালদারের বিষয়ে দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে কোনো কিছু এখনো জানায়নি। জানালে, দুই দেশের পূর্বনির্ধারিত নিয়ম মতো তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের আওতায় নেয়া হবে।
তিনি বলেন, পি কে হালদারের বিরুদ্ধে যেহেতু সে দেশেও মামলা চলমান, সে ক্ষেত্রে ভারতেও বিচার ও শাস্তি হতে পারে। পরে বাংলাদেশকে ফেরত দিলে এখানেও বিচার ও শাস্তি হবে। অথবা ভারত বিচার শেষে বাংলাদেশকে দিলে এখানেও শাস্তি কার্যকর হতে পারে। যোগাযোগ না হওয়ায় এখনই সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, জালিয়াতির কারণে ভারতের আইনে পি কে হালদারের বিচার হবে। তিনি মিথ্যা নাগরিকত্ব সনদ নিয়েছেন। জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। আমাদের এখানে অর্থপাচারের মামলাটা বিচারাধীন রয়ে গেছে। সেই মামলায় বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে তাকে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ দিকে দুদকের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, পি কে হালদারের একটি মামলার চার্জশিট হয়েছে। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করেছিলাম। আমরা ইতোমধ্যে ইন্টারপোল অথরিটির সাথে যোগাযোগ করেছি, তারা আমাদের জানিয়েছেন যে, তারা ইতোমধ্যে ভারতের যে ইন্টারপোল অথরিটি রয়েছে, সেখানে যোগাযোগ করেছেন এবং ওই আসামিকে দ্রুত যাতে বাংলাদেশে ফেরত নিয়ে আসা যায় সেই বিষয়ে ভারতে ইন্টারপোলের কাউন্টারপার্টের সাথে যোগাযোগ করেছেন। আমরা আশা করছি যত দ্রুত সম্ভব সেটি করা হবে। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যাতে যত দ্রুত সম্ভব আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরত আনা যায়।
তিনি বলেন ভারত থেকে কতদিনের মধ্যে ফেরত আনা যায় সেটি স্পেসেফিক বলা কঠিন। সেখানে মামলা বা এর বিচার কতদিন লাগবে অথবা বিচারের আগেও ফেরত আনা যাবে কি যাবে না, এই বিভিন্ন বিষয়ের কারণে সময়ের বিষয়টি নির্দিষ্টি করে বলা যাবে না।
সূত্র মতে, ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট থাকা আসামি হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনকে প্রাধান্য দিয়ে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট অ্যাক্ট, মানিলন্ডারিং অ্যাক্ট, ফরেনার্স অ্যাক্টসহ আট-দশটি মামলার আসামি হিসেবে প্রাথমিক অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারে ভারতীয় সংস্থাটি।
এর আগেও বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের আসামি নূর হোসেন, দিল্লির তিহার জেলে বন্দী থাকা বাদল ফারাজিকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। নূর হোসেনের ক্ষেত্রে অস্ত্র আইন ও ফরেনার্স অ্যাক্টের মামলা ছিল। যাবজ্জীবন সাজার আসামি বাদল ফারাজির ক্ষেত্রে ছিল সরাসরি খুনের অভিযোগ। দুই ক্ষেত্রেই ভারতের আদালতে ঘোষিত সাজার মেয়াদ বাংলাদেশে শেষ করতে হবেÑ এমন শর্তেই দুই আসামিকে ফেরত পেয়েছিল বাংলাদেশ।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের মতে, আদালতের মাধ্যমে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তির মাধ্যমে আইনি পথেই দেশে ফেরানো সম্ভব হবে। অবৈধভাবে নাগরিকত্ব নেয়ার অভিযোগে ভারতে তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হলে সেটি সময় সাপেক্ষও হয়ে উঠতে পারে।
সব মামলার অগ্রগতির তথ্য চেয়েছেন আদালত : দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচার করে পালিয়ে যাওয়া প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পি কে হালদার) দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জারি করা রুলের শুনানির জন্য আগামী ১২ জুন দিন ধার্য করেছেন হাইকোর্ট। গতকাল বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো: ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। একই সাথে আদালত পি কে হালদারের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর অগ্রগতির তথ্য জানাতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালত বলেন, আমরা আদেশ দিলে পৃথিবীর কোনো দেশে গিয়েও অর্থপাচারকারীরা শান্তি পাবে না। আদালত বলেন, আমাদের আদেশের কারণেই আজ পি কে হালদার সারা বিশ্বের মানুষের কাছে অর্থপাচারের অভিযোগে ভিন্নভাবে আলোচিত। এটা ভাবার সুযোগ নেই যে, অন্য দেশে গেলে আমরা তার বিরুদ্ধে আদেশ দিতে পারব না। আমাদের শুধু অর্থপাচারকারীর অবস্থানটা চিহ্নিত করে দিলেই আমরা তার বিরুদ্ধে আদেশ দিতে পারি। দেশের অর্থপাচারকারী বিষয়ে কোনো ছাড় নেই।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো: খুরশীদ আলম খান।
২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর পি কে হালদারকে গ্রেফতার ও দেশে ফিরিয়ে আনতে বিবাদিদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না এবং এ ক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
এর আগে ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের একই বেঞ্চে পি কে হালদারের দেশে ফেরত আসতে কোনোরকম গ্রেফতার না করার নির্দেশনা চেয়ে একটি আবেদন করে তার প্রতিষ্ঠান আইএলএফএসএল। সার্বিক দিক বিবেচনার পর তখন পি কে হালদারকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন হাইকোর্ট। পি কে হালদারের দেশে ফেরার বিষয়ে আইএলএফএসএলের করা আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ এসব আদেশ দেন। তবে পরে তিনি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে দেশে ফেরেননি। এতে থেমে যায় তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর অগ্রগতি।
গত ১৪ মে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) পশ্চিমবঙ্গ থেকে পি কে হালদারকে গ্রেফতার করে। সেখানে তিনি শিব শংকর হালদার নাম নিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে পি কে হালদারের ১১টি বাড়ি, জমি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছে ইডি। তার আরো সম্পদ পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে বলে মনে করছে সংস্থাটি। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পি কে হালদারকে তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।


আরো সংবাদ



premium cement