২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
ডেঞ্জার জোনে সুরমা কুশিয়ারা সিলেটের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হঠাৎ বন্যার আশঙ্কা

পদ্মা যমুনা ব্রহ্মপুত্রসহ উত্তরাঞ্চলের নদীতে পানি বাড়ছে
-

গত কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া বড় নদীগুলো যেমন যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মাসহ উত্তরাঞ্চলের তিস্তা ও ধরলার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বৃষ্টির চেয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলের ঢলের পানিতে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড পূর্বাভাস দিয়েছে। আজ সোমবার সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার কয়েকটি নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। ইতোমধ্যে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের সুরমা, অমলশীদে কুশিয়ারা ও সারিঘাটের সারিগোয়াইন নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। সিলেটে প্রবাহিত সুরমা ইতোমধ্যে বিপদসীমার ১২২ সেন্টিমিটার অতিক্রম করেছে।
আবহাওয়া সংস্থাগুলোর গাণিতিক মডেলভিক্তিক পূর্বাভাস বলছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের কিছু স্থানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত এই অঞ্চলগুলোতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে এবং প্রধান নদীগুলো যেমনÑ সুরমা, কুশিয়ারা, ভোগাই-কংস, ধনু-বাউলাই, মুনা এবং খোয়ালাইর পানি সমতল কিছু পয়েন্টে সময় বিশেষে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গতকাল রোববার সকাল ৯টা পর্যন্ত এর পূর্বের ২৪ ঘণ্টায় সিলেট অঞ্চলেই প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। রেকর্ড অনুযায়ী, সিলেটের লালখান বাজারে বৃষ্টি হয়েছে ১৯৩ মিলিমিটিার। জকিগঞ্জে ৭৫ মিলিমিটার, কানাইঘাটে ৬০ মিলিমিটার, ছাতকে ৫০ মিলিমিটার, সুনামগঞ্জের লোরেরগড়ে ১০৫ মিলিমিটার, সুনামগঞ্জে ৬৫ মিলিমিটার, শেওলায় ৭৫ মিলিমিটার, জাফলংয়ে ৬৫ মিলিমিটার, সিলেটের শেরপুরে ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ২১৮ মিলিমিটার, অরুণাচলের পাসিঘাটে ৮০ মিলিমিটার, আসামের গোয়ালপাড়ায় ৪৯ মিলিমিটার, আসামের তেজপুরে ৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির এই পানি তাৎক্ষণিক বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের নদী ও হাওরে পড়ছে আবার বাইরের পানিটা আসতে কিছুটা দেরি হচ্ছে দূরত্বের কারণে।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ভারী বর্ষণের কারণে সৃষ্ট ঢলের পানি ইতোমধ্যেই সিলেট ও সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতে ঢুকে হাওরে চাষ করা ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ওপরের দিকের পানি আসা অব্যাহত থাকায় প্রায় প্রতিদিনই হাওর অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে এবং বোরো ধানের ক্ষেত ডুবিয়ে খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, প্রতি বছরই সিলেট অঞ্চলের হাওরে মেঘালয় পাহাড়ের বর্ষণের পানি এসে পড়ছে আকস্মিকভাবে এবং ফসলের ক্ষতি করছে। এই ক্ষতির হাত থেকে কৃষকের ধান রক্ষা করা যেতে পারে বন্যার আগাম পূর্বাভাস দিয়ে। তা ছাড়া কৃষককে আগে থেকেই বন্যা বিষয়ক সতর্কতা দিয়ে আগাম চাষে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে যেন পানি আসার আগেই কৃষক ধান কেটে গোলায় তুলতে পারেন। সে জন্য কৃষি বিভাগ এগিয়ে আসতে পারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রতি বছরই পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে কৃষকের ধান, কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে প্রতিদিনের পূর্বাভাস মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে কমিউনিটি রেডিও ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সহযোগিতা নিয়ে কাজটি করা যায় বলে পরামর্শ দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
ডেঞ্জার জোনে সুরমা কুশিয়ারা সিলেটের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
সিলেট ব্যুরো জানায়, প্রকৃতিতে এখন গ্রীষ্মকাল। বর্ষা শুরু হতে এক মাস বাকি। গ্রীষ্মকাল চললেও যেন বর্ষার ঘনঘটা চারিদিকে। বন্যার পূর্বাভাস দেখা দিয়েছে সিলেটজুড়ে। গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণে সিলেটের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারা এখন বিপজ্জনক অবস্থানে (ডেঞ্জার জোন) রয়েছে।
এদিকে ভারী বর্ষণে আর উজানে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সিলেটের জকিগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলার লোকজন। জেলার পাঁচটি উপজেলা ছাড়াও সিলেট সদরের নিম্নাঞ্চলের মানুষজন পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বীজতলা, মাছেল খামার ও পুকুর ডুবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক ও খামারিরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটের জকিগঞ্জে সুরমার ছয়টি ডাইক ভেঙে প্লাবিত হয়েছে দুটি ইউনিয়নের ১০ হাজার মানুষ। ডাইক ভেঙে পানি প্রবেশ করেছে লোকালয়ে। ফলে তলিয়ে গেছে উপজেলার দুই ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে শত শত ঘরবাড়ির লোকজন। সুরমার ডাইক ভেঙে যাওয়া বারোহাল, মানিকপুর, কাজলসার ইউপিসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে বন্ধ হয়ে পড়েছে গ্রামীণ সড়কে যোগাযোগ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ধানী বীজতলা। পুকুর ও মৎস্য খামার তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ফিশারি মালিকরা।
পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা থাকায় তলিয়ে গেছে জকিগঞ্জের প্রধান ডাকঘর, প্রাণিসম্পদ অফিস, স্থল শুল্ক স্টেশন, জকিগঞ্জ ফাজিল সিনিয়র মাদরাসা, জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের হোসনাবাদ গ্রামের একাংশসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট তলিয়ে মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে।
এ ব্যাপারে জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পল্লব হোম দাস বলেন, জকিগঞ্জে কুশিয়ারার কোনো ডাইক ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বা ভাঙেনি। তবে উপজেলার মানিকপুর ইউনিয়নে সুরমার পাঁচটি ডাইক ভেঙেছে এবং বারোহালে একটি ডাইক ভেঙে অন্তত ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।
পাউবোর তথ্য বলছে, গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১.২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে শনিবারের চেয়ে রোববার বেড়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় সিলেট পয়েন্টে পানি ছিল ১০.৫১ সেন্টিমিটার। রোববার সন্ধ্যায় পানিসীমা দাঁড়িয়েছে ১০.৬২ সেন্টিমিটার। কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশিদ পয়েন্টে শনিবার সকালে বিপদসীমার ৯৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ নদীর পানি শেরপুর পয়েন্টে বেড়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় এ পয়েন্টে পানিসীমা ছিল ৬.৭০ সেন্টিমিটার থাকলেও শনিবার বেড়ে ৭.৭৩ সেন্টিমিটারে। পানি বেড়েছে ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টেও। এখানে শনিবার সন্ধ্যায় পানিসীমা ৮.০৯ সেন্টিমিটার থাকলেও রোববার সন্ধ্যায় দাঁড়ায় ৮.৫০ সেন্টিমিটারে। গোয়াইনঘাটের সারি নদীর পানি বিপদসীমার ০.৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি বৃদ্ধির কারণে সিলেটের গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলো তলিয়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগের প্রধান সড়কগুলো এখন পানির নিচে। শত শত ফসলি জমি ডুবে আছে।
এ অবস্থায় সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা এখনকার বন্যাকে আগাম বন্যা বলছেন না। তাদের মতে, এখন বন্যার সময়। সামনে বর্ষাকাল। তবে গ্রীষ্মকালকে বর্ষা বলার পেছনে যুক্তি দেখাতে গিয়ে তারা বলেন, প্রকৃতি তার নিয়মে পরিবর্তন হচ্ছে। যে কারণে ঋতুর পরিবর্তন ঘটছে। অসময়ে বন্যা দেখা দিচ্ছে। তবে নদীশাসন বা খনন না হওয়ার ফলে নদীর নাব্যতা হারানোর বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা।


আরো সংবাদ



premium cement