১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
শাবি শিক্ষার্থী আন্দোলন

কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে উত্তাল ক্যাম্পাস সুনসান

-

আন্দোলনে উত্তাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের চিত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বদলে গেল। অনশন ভাঙার পর গত বুধবার দুপুর থেকে ক্যাম্পাসে কমেছে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। টানা ১৪ দিনের আন্দোলন-ঝড় শেষে শান্ত হয়েছে শাবিপ্রবি। সংঘর্ষ, মিছিল, বিক্ষোভ আর উত্তেজনায় ক্যাম্পাস উত্তাল ছিল ১৩ থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত।
সরেজমিন দেখা যায়, ভিসির বাসভবনের সামনে অনশনকারীদের বিছানাপত্র নেই। পুরো ক্যাম্পাসে কয়েকজন সাংবাদিক, আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দু-একজন ছাড়া আর কেউ নেই। চারিদিকে সুনসান নীরবতা দেখে বোঝারই উপায় নেই ঘণ্টা কয়েক আগেই উত্তাল ছিল ক্যাম্পাসটি। সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় আন্দোলনকারী সবুর খানের সাথে। তিনি জানান, অনশনরত ছিলেন ২৮ জন। এর মধ্যে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাগিব-রাবেয়া হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেছে ২৪ জন। বাকি চার জন বাড়িতে গেছেন। তারা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নেবেন। ভর্তি হওয়া ছয়জনের মধ্যে তিনজনের প্রচণ্ড জ্বর ও খিঁচুনি আছে।
জানা যায়, শুরুটা ছিল ছাত্রীদের। দাবি হলো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ছাত্রী হলের প্রভোস্টের অপসারণ। গত ১৩ জানুয়ারি রাতেই ক্যাম্পাসে আন্দোলনে নামেন ওই হলের ছাত্রীরা। আন্দোলনরত ছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা পরিস্থিতি করেছে জটিল। এর জেরে বিশ^বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী একযোগে শুরু করেন আন্দোলন, বিক্ষোভ, অনশন, ঘেরাও। এরপর ভিসির ডাকে পুলিশি অ্যাকশন। পুলিশের লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেডে শিক্ষার্থীসহ ক্যাম্পাসের অন্তত অর্ধশত লোকজন আহত হন। সে ঘটনায় পুলিশ ‘গুলিবর্ষণ ও হত্যার উদ্দেশ্যে মারধরের অভিযোগ’ এনে অজ্ঞাতপরিচয় ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে উল্টো ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তারা অনশনে যান। ঘোষণা দেন ভিসির পদত্যাগ না করা পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার। ভিসির বাংলোর সামনে রাস্তায় শামিয়ানা টাঙিয়ে অনশনে বসেন আন্দোলনকারীরা। এভাবে কেটে যায় দুই সপ্তাহ। কিন্তু দুই পক্ষই অনড়। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সিলেটের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনির সাথে শিক্ষার্থীদের আলোচনাও কোনো ফল দেয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের অমরন অনশনের সাত দিন পর সেই অনশন ভাঙালেন এক শিক্ষকদম্পতি। গতকাল বুধবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুই শিক্ষক জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হক পানি পান করিয়ে শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙান। এরপর দুপুর ১টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ফাঁকা হতে থাকে। বিকেল ৩টায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আনাগোনা বা কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি। অনশন ভাঙার পরও মূল দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। তবে বিশ^বিদ্যালয়ে প্রধান ফটক, ভিসির বাস ভবনের ফটকসহ অন্যান্য ফটকের অবরোধ তুলে নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বুধবার রাত পৌনে ১১টায় প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের এক মুখপাত্র।
ভিসিকে সরানো হচ্ছে : অবশেষে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। দু-চার দিনের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। এ ছাড়া শাবিপ্রবি শিক্ষকদের থেকেই নতুন ভিসি নিয়োগ দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। বৃহস্পতিবার সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এমন আভাস মিলেছে বলে গণমাধ্যমের খবরে উঠে এসেছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে সরকারের কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, শাবিপ্রবির আন্দোলন পরিস্থিতি ও সার্বিক বিষয় নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে নানা তথ্য উঠে আসে। এসব প্রতিবেদন নীতিনির্ধারণী দফতরে জমা দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু শাবিপ্রবি নয়, ভবিষ্যতে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে একই ব্যক্তিকে ভিসি নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি নিরুৎসাহিত করা বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া শাবিপ্রবির ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের কোনো উপযুক্ত শিক্ষককে মনোনীত করা যেতে পারে।
প্রতিবেদনে উঠে আসে, শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আন্দোলনে নামলেও শুরু থেকে তা আমলে নেননি ভিসি। তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে কোনো আলোচনায় বসেননি, এমনকি কোনো বিবৃতিও দেননি। বর্তমান ভিসির এমন একরোখা মনোভাব আন্দোলনের গতিকে আরো ত্বরান্বিত করেছে।
প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে, শাবিপ্রবির বর্তমান আন্দোলনে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের ছাত্র অধিকার পরিষদ ও বাম সংগঠনগুলো নানাভাবে উসকানি-মদদ দিয়ে ভিন্ন খাতে নেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে একে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার অপতৎপরতা রয়েছে।
একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, নতুন ভিসি হিসেবে বর্তমানে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দু’জন শিক্ষকের নাম জোরেশোরে আলোচনায় রয়েছে তারা হলেনÑ বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তুলসী কুমার দাস ও বর্তমান কোষাধ্যক্ষ ড. আনোয়ারুল ইসলাম।
শাবির শিক্ষক রাজনীতি : বর্তমানে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের দু’টি ধারা রয়েছে। একটি হলোÑ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ, অপরটি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ। বর্তমান শিক্ষক সমিতিসহ সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের মূল গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে সরকারের কাছে দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের সদ্য পদত্যাগী প্রভোস্ট অধ্যাপক জাফরিন আহমেদ লিজা শিক্ষক পরিষদে আছেন। প্রভোস্ট কমিটির একজন সিন্ডিকেট সদস্যও তিনি। আগামী ২ ফেব্রুয়ারি সিন্ডিকেট কমিটির নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। শিক্ষার্থীরা অধ্যাপক জাফরিনের পদত্যাগ দাবি করলেও শুরুতে শিক্ষক পরিষদ তাদের প্যানেলের সিন্ডিকেটের একজন সদস্যের প্রত্যাহারে রাজি ছিল না। অন্য দিকে মুক্তচিন্তায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষক প্যানেল প্রভোস্ট সরিয়ে দেয়ার পক্ষে ছিল। যদিও আন্দোলনের মুখে জাফরিনকে সরিয়ে অধ্যাপক নাজিয়া চৌধুরীকে প্রভোস্ট করা হয়। নাজিয়া মুক্তচিন্তায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষক প্যানেলের সমর্থক। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শাবিপ্রবিতে বর্তমানে সিন্ডিকেট কমিটির নির্বাচন স্থগিত আছে।


আরো সংবাদ



premium cement