১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও র্যাবে নিষেধাজ্ঞার আহ্বান

ইইউকে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যের চিঠি
-

বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। আর এ আহ্বান জানিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ইভান স্টেফানিক। ইইউর পররাষ্ট্র সম্পর্ক ও নিরাপত্তা নীতিবিষয়ক হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ জোসেফ বরলির কাছে লেখা চিঠিতে তিনি একই সাথে সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন, রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্বের অভিযোগ এনে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ইইউর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার দেয়া চিঠিতে স্টেফানিক লিখেছেন, আমি বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের অমানবিক আচরণ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন উল্লেখযোগ্য। পরিস্থিতি বর্তমানে খুবই গুরুতর। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশ পুলিশ প্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যিনি আগে র্যাবের প্রধান ছিলেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিশেষ করে ২০১৮ সালের মে মাসে টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হককে হত্যার জন্য এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া ম্যাগনিটাইনেজ গ্লোবাল প্রোগ্রামের আওতায় র্যাবের আরো পাঁচজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাসহ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সিনেটর র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বছরের পর বছর ধরে বলে আসছিলেন।
চিঠিতে দ্যা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশ ও র্যাবের দ্বারা ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১১৩৪টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে আমি র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য আপনার ক্ষমতা ব্যবহারের অনুরোধ করছি।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদন ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স ম্যান’ এর প্রসঙ্গ টেনে স্টেফানিক লিখেছেন, এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশ একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, যেখানে মাফিয়াদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সরকার দুর্নীতি করছে। বাংলাদেশের জনগণ মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী, অবৈধ এবং অগণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে বসবাস করছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশে গুম হওয়া নাগরিকদের সংখ্যা আরেকটি ভীতিকর পরিসংখ্যান। এই সংখ্যা ৫০০’র বেশি। জাতিসঙ্ঘ এ বিষয়ে তদন্ত করেছে। জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞ এবং ইইউ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা করেছে। এই আইনের মাধ্যমে মুক্তচিন্তা, অনলাইনে ভিন্নমত দমন এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গলা চেপে ধরা হয়েছে বলে উল্লেখ করে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এই সদস্য বলেছেন, বাংলাদেশে সংবাদপত্রের জন্য ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি ও অত্যাচার করা হচ্ছে। আদালতগুলো সরকার দ্বারা প্রভাবিত। নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত এবং বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তের মধ্যে খুবই সামান্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সাধারণ নাগরিক এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দ্বিমত করার সুযোগ নেই। দ্যা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের মতে, গত বছর দক্ষিণ এশিয়ায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন। মুক্তচিন্তা এবং সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনাকারীকে নির্যাতন, গুম এবং অত্যাচারের শিকার হতে হয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুবই মারাত্মক। আমি আপনাকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
চিঠিতে স্টেফানিক লিখেছেন, জাতিসঙ্ঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির সুপারিশে ২০২৬ সালে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ একটা দূরদর্শী বিষয়। ২০১৮ এবং ২০২১ সালে পরপর দুইবার মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মান উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ এই স্ট্যাটাস পাবে। বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশের চেয়ে অনেকগুলো সূচকে এগিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে দুই দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপরে রয়েছে। চলমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো শেষ হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আরো সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নের একটা বড় বাধা হলো মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতি।
ইতিবাচক ভাবমর্যাদা তুলে ধরতে লবিস্ট নিয়োগ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন বলেছেন, দেশের ইতিবাচক ভাবমর্যাদা ও আওয়ামী লীগের সুশাসনের বিষয়গুলো তুলে ধরার জন্য সরকার বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। তবে সরকার এটাকে পিআর (জনসংযোগ) ফার্ম হিসেবে দেখে। কিন্তু বিএনপি দেশের ক্ষতি করার জন্য বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে।
রাজধানীর আগারগাঁও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গতকাল মঙ্গলবার একটি প্রদশর্নীর উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন। ড. মোমেন বলেন, লবিস্ট নিয়োগ করা আইনবিরোধী না, কিন্তু দেখতে হবে কী কারণে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে, উদ্দেশ্য কী? যখন দেশের ক্ষতির জন্য অন্যকে অর্থ দেয়া হয়, তদবির করার জন্য লবিস্ট নিয়োগ করা হয়, সেটা খুবই অন্যায়। বিএনপি যে কয়টা লবিস্ট নিয়োগ করেছে এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের ক্ষতি করা। এ ব্যাপারে আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য আছে। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত লবিস্ট নিয়োগ করেছিল যাতে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি না হয়। তখন আওয়ামী লীগ ভুল ধারণাটা পরিবর্তন করার জন্য লবিস্ট নিয়োগ করেছে। লবিস্ট নিয়োগের প্রথা সাবেক সামরিক শাসক এরশাদের আমল থেকে চালু হয়েছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এগুলো অনেক দিন ধরেই চলছে, নতুন কিছু না। সবই ওয়েবসাইটে আছে, কোনো কিছু লুকানো না।
অনুষ্ঠানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা: এনামুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারা জাকেরসহ ঢাকায় নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত এবং ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেডক্রসের (আইসিআরসি) বাংলাদেশ প্রধান উপস্থিত ছিলেন।
সকালে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চান র্যাবকে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশন নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে ১২টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার চিঠি কোনো প্রভাব ফেলবে কি না? জবাবে ড. মোমেন বলেন, জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য যাচাই-বাছাই করে লোক নেয়া হয়। এটা জাতিসঙ্ঘের মুখপাত্রই বলেছেন। তাই এটা নিয়ে মিডিয়ায় হইচই হলেও আমার মনে হয় খুব বড় ধরনের কোনো আঘাত আসবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে র্যাব অত্যন্ত পারদর্শিতা ও সততার সাথে কাজ করছে। এ কারণে বাংলাদেশের মানুষের কাছে র্যাব গ্রহণযোগ্য।
অভিযোগ ভিত্তিহীন : এ দিকে র্যাবের একজন মুখপাত্র জানান, জাতিসঙ্ঘকে দেয়া ১২টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার চিঠিতে র্যাব সম্পর্কে করা অভিযোগ ভিত্তিহীন। জাতিসঙ্ঘ অবশ্যই এটা যাচাই করে দেখবে। জাতিসঙ্ঘ থেকে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক চিঠি পেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জবাব দেয়া হবে।


আরো সংবাদ



premium cement