২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`
জেনোসাইড ওয়াচের হুঁশিয়ারি

রুয়ান্ডার মতো ভারতেও গণহত্যার শিকার হতে পারেন মুসলিমরা

-

নরেন্দ্র মোদি সরকারের অধীনে ভারতের পরিস্থিতিকে মিয়ানমারের ঘটনার সাথে তুলনা করে ভারতে মুসলিমদের আসন্ন গণহত্যার বিষয়ে সতর্ক করেছেন জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর গ্রেগরি স্ট্যান্টন। ১৯৯৪ সালে সংঘটিত হওয়ার কয়েক বছর আগে রুয়ান্ডায় গণহত্যার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তিনি। ডন।
১৯৯৯ সালে গঠিত, জেনোসাইড ওয়াচ গণহত্যা প্রতিরোধে নিবেদিত একটি বিশ্বব্যাপী সংস্থা। ডক্টর স্ট্যান্টন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া, ফেয়ারফ্যাক্স কাউন্টির জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা অধ্যয়ন এবং প্রতিরোধের একজন প্রাক্তন গবেষণা অধ্যাপক। ইন্ডিয়ান আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিল আয়োজিত ‘কল ফর জেনোসাইড অব ইন্ডিয়ান মুসলিম’ শীর্ষক কংগ্রেসনাল ব্রিফিংয়ে স্ট্যান্টন এই মন্তব্য করেন। তিনি অধিবেশনে বক্তৃতা করার জন্য আমন্ত্রিত পাঁচ সদস্যের প্যানেলের অংশ ছিলেন।
তার ভিডিও ভাষণে ডক্টর স্ট্যান্টন তার বক্তব্য শুরু করেছিলেন এই বলে যে, জেনোসাইড ওয়াচ ২০০২ সাল থেকে ভারতে একটি গণহত্যার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিল, ‘যখন গুজরাটে দাঙ্গা ও গণহত্যা হয়েছিল যাতে এক হাজারেরও বেশি মুসলমান নিহত হয়’। তিনি বলেন, ‘তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি এবং তিনি কিছুই করেননি। আসলে অনেক প্রমাণ রয়েছে যে, তিনি আসলে সেই গণহত্যাকে উৎসাহিত করেছিলেন।’ মোদি এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি তার রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি করতে ‘মুসলিম বিরোধী, ইসলামোফোবিক বাক্যালঙ্কার’ ব্যবহার করেছিলেন।
স্ট্যান্টন বলেন, মোদি যে দু’টি উপায় নিয়েছিলেন তা হলো ২০১৯ সালে ভারত-অধিকৃত কাশ্মিরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা প্রত্যাহার করা এবং একই বছর নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন পাস করা। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, অধিকৃত কাশ্মিরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার করার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উপত্যকায় ‘হিন্দু আধিপত্য পুনরুদ্ধার করা’। তিনি আরো বলেন, ‘‘নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন প্রণয়নে বিশেষত ‘মুসলিমরাই লক্ষ্য’। এটি আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট সুবিধাজনক মর্যাদা দিয়েছে, যারা নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর ছিল। কিন্তু যে একটি দলকে বাদ দেয়া হয়েছিল তারা ছিল মুসলমান।’’ তিনি বলেন, ‘এই আইনটি ছিল বিশেষভাবে মুসলিমদের লক্ষ্য করে, যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যা ও গৃহযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসে আসামে বসতি স্থাপন করেছিল’।
স্ট্যান্টন বলেন, প্রায় ৩০ লাখ মানুষ, যাদের বেশির ভাগই মুসলমান, ভারতে পালিয়ে এসেছেন এবং ‘ভারতের নিয়মিত নাগরিক’ হিসেবে ‘স্থায়ী’ হয়েছেন। কিন্তু নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন অনুযায়ী ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে থাকা আদমশুমারির অংশ হিসাবে লোকেদের ডকুমেন্টেশনের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে, তারা ১৯৭১ সালের আগে ভারতের নাগরিক ছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘অবশ্যই এখন অনেক লোকের কাছে এই ধরনের ডকুমেন্টেশন নেই’। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে ‘মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাথে ঠিক এটিই করেছিল’। মিয়ানমার সরকার প্রথমে একটি আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের অ-নাগরিক ঘোষণা করেছে এবং তারপরে সহিংসতা ও গণহত্যার মাধ্যমে তাদের বহিষ্কার করেছে। তিনি বলেন, ‘এটি বিশেষভাবে একটি জাতীয়, জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে এবং এটিই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে করেছে’। ভারতকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন যেটির মুখোমুখি হচ্ছি এটি অনুরূপ একটি একটি চক্রান্ত’।
স্ট্যান্টন বলেছেন, ‘ভারত সরকারের লক্ষ্য ছিল নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের অধীনে আদমশুমারি সারা দেশে প্রসারিত করা এবং এর শিকার হবে ভারতের ২০ কোটি মুসলমান’। তিনি আরো বলেন যে, ‘হিন্দু জাতি হিসেবে ভারতের ধারণা, ভারতের ইতিহাস ও ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী। ভারতীয় সংবিধান ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ করার জন্য’ তৈরি করা হয়েছিল এবং যে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তা কংগ্রেস পার্টির অধীনে ভারতের অস্তিত্বের প্রথম বছরগুলোতে সুরক্ষিত হয়েছিল।
চরমপন্থী, হিন্দুত্ব-ভিত্তিক গোষ্ঠী আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ)-এর একজন প্রকৃত সদস্য মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। একজন চরমপন্থী দায়িত্ব নিয়েছেন। স্ট্যান্টন তারপর ব্যাখ্যা করেন যে, গণহত্যা একটি ঘটনা নয়; বরং একটি প্রক্রিয়া এবং ভারতের আসাম রাজ্য ও অধিকৃত কাশ্মিরে গণহত্যার প্রাথমিক ‘লক্ষণ ও প্রক্রিয়া’ রয়েছে।
তিনি উত্তরাখন্ডের তীর্থস্থান শহর হরিদ্বারে ১৭ থেকে ১৯ ডিসেম্বর হিন্দুত্ববাদী নেতা ইয়াতি নরসিংহানন্দের একটি কনক্লেভের উল্লেখ করেছেন, যেখানে সংখ্যালঘুদের হত্যা এবং তাদের ধর্মীয় স্থানগুলোতে আক্রমণ করার একাধিক আহ্বান জানানো হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানটি গণহত্যাকে উসকে দেয়ার লক্ষ্যে ছিল। ভারতে এমন কিছু আইন রয়েছে, যা এই জাতীয় অনুশীলনের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যেতে পারে, ‘কিন্তু মোদি সেই সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেননি’।
স্ট্যান্টন বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির এই ধরনের ঘৃণা ও ঘৃণাত্মক বক্তৃতাকে নিন্দা করার নৈতিক দায়িত্ব ছিল, যা বিশেষভাবে মুসলমানদের হত্যার আহ্বান জানায়। তিনি বলেন যে, হরিদ্বার সভায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি ভারত সরকারও ব্যবহার করেছিল, তা আসলে ‘মেরুকরণ’ ছিল, যা গণহত্যার দিকে পরিচালিত করে। ‘সুতরাং আমরা সতর্ক করছি যে, ভারতে গণহত্যা খুব দ্রুতই ঘটতে পারে।’ তিনি ভারতের পরিস্থিতিকে রুয়ান্ডার ঘটনার সাথে তুলনা করেছেন, যেখানে ১৯৯৪ সালে একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। ডক্টর স্ট্যান্টন বলেন, তিনি রুয়ান্ডায় গণহত্যার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সে সময় দেশের পরিস্থিতি মাথায় রেখে। তিনি জানিয়েছেন, তিনি রুয়ান্ডার তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করেছিলেন যে ‘আপনি যদি আপনার দেশে গণহত্যা প্রতিরোধে কিছু না করেন তবে পাঁচ বছরের মধ্যে এখানে একটি গণহত্যা হতে চলেছে। সেটি ১৯৮৯ সালে। গণহত্যার বিকাশ ঘটে, ঘৃণা-বক্তৃতা বিকশিত হয়েছে, সব প্রাথমিক সতর্কতা চিহ্ন বিকশিত হয়েছে এবং আমরা জানি, ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় ৮০ হাজার তুতসি এবং অন্যান্য নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল’। উপসংহারে তিনি বলেন, ‘আমরা ভারতে এটি হতে দিতে পারি না’।


আরো সংবাদ



premium cement