২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

তিন বন্ধু আবিষ্কার করল ‘মাটির প্রাণ’ ডিভাইস

কৃষক করতে পারবেন মাটি পরীক্ষা, জানতে পারবেন কোন ফসল ফলাবেন, পাবেন সার ব্যবহারের পরামর্শও
-

কৃষক বা কৃষির সাথে জড়িত ব্যক্তি নিজেই করতে পারবেন তার জমির মাটি পরীক্ষা। মাত্র পাঁচ মিনিটেই জানতে পারবেন তার জমির মাটির গুণাগুণ। একটা ডিভাইস নিয়ে মাঠে যাবেন কৃষক। যাওয়ার পর এই ডিভাইসটির সেন্সর দিয়ে মাটির আর্দ্রতা, পিএইচ, নাইট্রোজেন ফসফরাস, পটাশিয়ামÑ এগুলো পরিমাপ করবেন। পরিমাপের পর যে ফল আসবে (মাটির আর্দ্রতা ১০ শতাংশ, পিএইচ ৭ বা অন্যগুলোর তথ্য) সেগুলো মোবাইল অ্যাপের মধ্যে দেয়া হবে। এরপর মোবাইল অ্যাপ তাৎক্ষণিক ক্যালকুলেট করে জানিয়ে দেবে মাটির সার্বিক অবস্থা। যেমনÑ মাটিতে সারের পরিমাণ কম আছে নাকি বেশি, কোন ধরনের সার কী পরিমাণ দরকার হবে এবং কোন ধরনের ফসল ভালো হতে পারেÑ সেই পরামর্শ আসবে তাৎক্ষণিকভাবে। মাটিতে যদি পিএইচের পরিমাণ বেশি থাকে কিভাবে কমাতে হবে, কী সার দিতে হবে; নাইট্রোজেনের পরিমাণ কম থাকলে কিভাবে বাড়াতে হবে, বেশি থাকলে কিভাবে কমাতে হবেÑ সবকিছুই ক্যালকুলেট করে নির্ণয় করা যাবে একটি যন্ত্রের মাধ্যমে।
এই মাটি পরীক্ষার ডিভাইস বা যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন তিন তরুণ। যারা সবাই ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক শিক্ষার্থী। আব্দুল্লাহ আল আরাফ, রাহাত উদ্দিন এবং রেজাউল খান নামের এই তিন বন্ধুর আবিষ্কারটির নাম দিয়েছেন ‘মাটির প্রাণ’। কৃষিবান্ধব ডিজিটাল পোর্টেবল সয়েল টেস্টিং ডিভাইস (মাটি পরীক্ষার যন্ত্র) এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে। বর্তমানে তারা তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অনুদানে একটি প্রকল্পের আওতায় গবেষণাটি এগিয়ে নিচ্ছেন। এটিকে কৃষক বা ভোক্তাপর্যায়ে নিতে আরো চয়-সাত মাস সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন তিন তরুণের অন্যতম আব্দুল্লাহ আল আরাফ। নয়া দিগন্তকে তিনি জানান, প্রথমে এই ধরনের আইডিয়া আমার মাথা থেকেই আসে। আমি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করি। আমার এই আইডিয়ার সাথে রাহাত ও রেজাউল একাত্মতা প্রকাশ করেন। এরপর আমরা এ নিয়ে কাজ শুরু করি।
গবেষকরা বলছেন, আমাদের দেশের কৃষি খাত প্রযুক্তির দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। তাই আমরা আমাদের ডিপ্লোমার শেষের দিকে গ্রামে চলে যাই। আমাদের এলাকার যারা কৃষিকাজের সাথে যুক্ত তাদের সাথে অনেক দিন কাটাই। তাদের সাথে কথা বলি, তাদের সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করি। শেষে দেখতে পাই যে, তারা বেশির ভাগ সময় শুধু ধারণার ওপর ভিত্তি করেই জমি চাষ, পানি দেয়া, সার দেয়াÑ এগুলো করে আসছেন। যার ফলে বিভিন্ন সময় তারা তাদের কাক্সিক্ষত ফলন পাচ্ছেন না। তাদের এসব কিছু অ্যানালাইসিস করে আমরা বুঝতে পারি যে, এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে, মাটি পরীক্ষা করে তারপর চাষের সিদ্ধান্ত নেয়া; কিন্তু আমাদের দেশের বেশির ভাগ কৃষক গ্রামে বাস করে। বছরের পর বছর ধরে তারা তাদের গতানুগতিকভাবে ফসল চাষ করে যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের বেশির ভাগ কৃষকই মাটি পরীক্ষার বিষয়ে আগ্রহী নয়। এর কারণ হচ্ছে বর্তমানে ফসলের মাঠের মাটি পরীক্ষার জন্য যে পদ্ধতি মানা হয় তাতে অনেক ঝক্কিঝামেলা রয়েছে। কৃষককে মাঠ থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে নিয়ে যেতে হয়। এরপর একটি নির্দিষ্ট ফি’র বিনিময়ে তার নমুনা মাটিটুকু দিয়ে আসেন পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষার ফলাফল আসতে সময় লাগে ২৫-৩০ দিন। এই মাটি পরীক্ষার সহজ উপায় যদি কৃষকের হাতের কাছে পৌঁছানো যায় তাহলে কৃষক এই মাটি পরীক্ষার প্রতি আগ্রহী হবেন।
তিন তরুণ গবেষকের মধ্যে আব্দুল্লাহ আল আরাফের বাড়ি নোয়াখালীর মাইজদীতে। ঢাকা পলিটেকনিক থেকে কম্পিউটার টেকনোলজি বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন ২০১৮ সালে। সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটিতে সিএসসি ডিপার্টমেন্ট থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। রাহাত উদ্দিনের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তরের। গ্রামের ইমামপুর পল্লী মঙ্গল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করেন। এরপর ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ইলেকট্র্রনিকস টেকনোলজি বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন ২০১৮ সালে। বর্তমানে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্র্রনিকস ডিপার্টমেন্ট থেকে গ্র্যাজুয়েশন করছেন। আরেক গবেষক রেজাউল খানের বাড়ি গাজীপুরে। তিনিও ঢাকা পলিটেকনিকে কম্পিউটার টেকনোলজি বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন ২০১৮ সালে। বর্তমানে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটিতে সিএসসি ডিপার্টমেন্ট থেকে গ্র্যাজুয়েশন করছেন।
আব্দুল্লাহ আল আরাফ জানান, আমরা তিন বন্ধু মিলে মাটি গবেষণার আইডিয়াকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে কাজ শুরু করি। শুরুতেই আমরা কী কী দিক নিয়ে কাজ করব তা ঠিক করি। আমরা আমাদের প্রজেক্টের নাম দেই ‘মাটির প্রাণ’। এই প্রজেক্টটি হচ্ছে কৃষিবান্ধব ডিজিটাল পোর্টেবল সয়েল টেস্টিং ডিভাইস। এটি বেশ কিছু সেন্সরের সমন্বয়ে গঠিত, যার সাথে একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন আছে। কৃষক তার ফসলের মাঠে বসেই মাটি পরীক্ষা করে ফসলের মাঠের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবেন এই ডিভাইসের মাধ্যমে। কৃষক ডিভাইসটি নিয়ে মাঠে যাবেন এবং জমিতে ৯টি ব্লকে চিহ্নিত করে মাটির নমুনা সংগ্রহ করবেন। সংগৃহীত নমুনা মাটি থেকে দ্রবণ (মিশ্রণ) তৈরি করবেন এবং সেই দ্রবণে পিএইচ সেন্সরের মাধ্যমে মাটির মান নেবেন। আর্দ্রতা পরিমাপক সেন্সরকে মাঠের মাঝামাঝি স্থাপন করে মাটির আর্দ্রতার মান নেবেন। এরপর মাটির নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম পরিমাপ করবেন। মাটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো আমাদের মাটির প্রাণ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে ইনপুট দেবেন। মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি সম্পূর্ণ বাংলায় তৈরি করা। ফলে একজন কৃষক খুব সহজেই এটি ব্যবহার করতে পারবেন। অ্যাপ ইনপুটকৃত তথ্যগুলোকে বিশ্লেষণ করে মাটির বর্তমান অবস্থা, পুষ্টি উপাদান, কী পরিমাণ সার দিতে হবে এবং ওই মাটিতে কী ফসল ভালো হবে তা বলে দেবে।
আব্দুল্লাহ বলেন, আমাদের এই ‘মাটির প্রাণ’ অ্যাপ্লিকেশনে কৃষকদের জন্য বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ কৃষকের স্বাস্থ্য। আমাদের কৃষকরা বিভিন্ন সময় মাঠে অনেক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন। তখন তারা বুঝে উঠতে পারেন না যে, কী করবেন। আমাদের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে সেসব প্রাথমিক চিকিৎসাগুলো সম্পর্কে জানতে পারবেন। এ ছাড়াও তারা মাঠে কীটনাশক প্রয়োগ সম্পর্কে, কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সার দেবেন সে বিষয়ে সব নির্দেশনাবলি পাবেন। কৃষকরা যাতে তাদের অঞ্চলের কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ এবং তার সমস্যাগুলো দ্রুত পৌঁছাতে পারেন সে ব্যবস্থাও আছে। কৃষি কর্মকর্তা ও আমাদের এই অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে তার অঞ্চলের রেজিস্টার্ড কৃষকদের ফসলের অবস্থা, কী কী চাষাবাদ হচ্ছে সব তথ্য পাবেন এবং কৃষকদের দ্রুত তথ্য সরবরাহ করতে পারবেন।
রাহাত উদ্দিন জানান, আমাদের এই ডিভাইসটি চাঁদপুর ও কুমিল্লায় কৃষকদের মধ্যে পাইলটিং পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের ইচ্ছা এটিকে সারা দেশের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের ছয় লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। আমরা আশা করছি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে ভোক্তা বা কৃষকপর্যায়ে ব্যবহারের উপযোগী হিসেবে তৈরি করতে সক্ষম হবো। আরেক গবেষক রেজাউল খান বলেন, ডিভাইসটি কৃষকের হাতে যতটা স্বল্প মূল্যে সহজলভ্যভাবে তুলে দেয়া যায় সেভাবেই আমরা চিন্তা করছি।
এই তিন তরুণ গবেষক জানান, শুরুর দিকে নিজেদের খরচে তারা এক বছর গবেষণাকাজ চালিয়ে যান। এই ধরনের গবেষণাকাজের জন্য একটা ভালো ল্যাবের প্রয়োজন ছিল। আবার প্রজেক্টের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দেশের বাইরে থেকে আমদানি করার বিষয় ছিল। ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারস, বাংলাদেশ (আইডিইবি’র) সভাপতি এ কে এম এ হামিদ তাদের আইডিইবিতে গবেষণার জন্য একটি আইওটি অ্যান্ড রোবটিক্স রিসার্চ ল্যাব স্থাপন করে দেন। তারা আরো জানান, আমরা পুরোদমে গবেষণা চালিয়ে যাই। আমাদের এই ‘মাটির প্রাণ’ প্রজেক্ট নিয়ে থাইল্যান্ড শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করি। সেখানে সাতটি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় হওয়ার গৌরব অর্জন করে ‘মাটির প্রাণ’। এরপর সেখান থেকে ফিরে ‘ব্যাসিস ন্যাশনাল আইসিটি অ্যাওয়ার্ডে’ অংশ নিয়ে সিনিয়র স্টুডেন্ট ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হন তারা। ২০১৯ সালে ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত এপিক্টা অ্যাওয়ার্ডে অংশ নেন। এই প্রজেক্টকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরাফ, রাহাত ও রেজাউল তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অনুদানের জন্য আবেদন করেন। তাদের এই আইডিয়াটা পছন্দ করে ছয় লাখ টাকা অনুদান দেয় তথ্য ও প্রযক্তি মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্পে তাদের মেন্টর হিসেবে আছেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রফেসর ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ আল মামুন।
ডিভাইসটি বানাতে আট হাজার টাকা খরচ পড়েছে উল্লেখ করে আব্দুল্লাহ আল আরাফ জানান, ‘মাটির প্রাণ’ ডিভাইসটি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস কর্তৃৃক রেজিস্টার্ড হয়েছে। এখন শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে প্যাটার্ন নিতে আবেদন প্রক্রিয়াধীন। এরপর চূড়ান্তভাবে তথ্য ও প্রযক্তি মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রেজেন্টেশন করা হবে। যেহেতু কৃষি বা কৃষকদের সুবিধার জন্যই এই আবিষ্কার তাই এখন আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন দরকার। আমরা চাই সরকার যেন কৃষকের মধ্যে আমাদের এই প্রযুক্তিটি ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে। সরকারের পাশাপাশি আমরা প্রাইভেট পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোও এ বিষয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান করছি।


আরো সংবাদ



premium cement