২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

পার্থক্য বাড়ছে ব্যাংক খোলা বাজারে ডলারের দামে

সঙ্কট সৃষ্টির আশঙ্কা
-

খোলাবাজারে ডলারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ কারণে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডলারের দাম। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে যেখানে ডলারের মূল্য ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা, সেখানে খোলাবাজারে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোনো কোনো সময় ৯২ টাকা ৫০ পয়সায়ও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, করোনায় কারণে দীর্ঘ দিন ভ্রমণ ভিসায় বিদেশে যাতায়াত কম ছিল; কিন্তু গত জুনের পর থেকে পুনরায় ভ্রমণ ভিসায় যাতায়াত বাড়ছে। এতে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। কিন্তু আন্তঃপ্রবাহ কমে যাওয়ায় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। বিপরীতে ব্যাংকিং খাতেও ডলারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সবমিলেই খোলাবাজারে ডলার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
মুদ্রাবাজার বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, ব্যাংক থেকে খোলাবাজারে ডলারের দাম পাঁচ টাকা পার্থক্য মুদ্রাবাজারের জন্য মোটেও সুখকর নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, খোলাবাজারে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করার তেমন কোনো পথ খোলা নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিমানবন্দর দিয়ে ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে কি না এটা দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, মূলত প্রধান তিনটি কারণে খোলাবাজারে ডলারের সঙ্কট দেখা দেয় এবং ব্যাংকের চেয়ে দাম বেড়ে যায়। প্রথমত, দেশ থেকে যখন ডলার পাচার বেড়ে যায় তখন খোলাবাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। এ কারণে পাচারকারীরা অধিক দামে হলেও ডলার কিনে নেয়। সাধারণত ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করলে এবং সে অর্থ ডলারের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করলে বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায় বলে তারা মনে করছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, দ্বিতীয়ত চোরাকারবার বেড়ে গেলেও ডলারের সঙ্কট দেখা দেয়। অবৈধ পণ্য যখন দেশে প্রবেশ করে তখন তা হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। এ পরিস্থিতিতে বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। এতে প্রভাব পড়ে মূল্যের ওপর।
তৃতীয়ত, অনেকসময় অসাধু ব্যবসায়ীরা শুল্ক ফাঁকি দেয়ার জন্য আন্ডার ইনভয়েসিং করে থাকে। আন্ডার ইনভয়েসিং হলো, কোনো পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্য দেখানো। যেমনÑ ১০০ টাকার পণ্য ৬০ টাকা দেখিয়ে আমদানি করে। ৬০ টাকার সমপরিমাণ ডলার ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। বাকি ৪০ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ৬০ টাকার ওপর শুল্ক পরিশোধ করেন, বাকি ৪০ টাকা ঘোষণা না করায় এর ওপর কোনো কর দিতে হয় না।
আবার অনেকসময় লাগেজ পার্টির দৌরাত্ম্য বেড়ে গেলে বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। যেমন কেউ কেউ ভ্রমণ ভিসায় কোনো দেশে গেলে বৈধভাবে একটি নির্ধারিত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাথে নিতে পারেন; কিন্তু অনেকসময় শুল্ক ফাঁকি দেয়ার জন্য লাগেজের মাধ্যমে মূল্যবান পণ্য আনা হয়। এতে বাড়তি ডলার পরিশোধ করা হয় হুন্ডির মাধ্যমে। এর ফলে বাজারে ডলারের সঙ্কট সৃষ্টি হয়।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, দীর্ঘ প্রায় এক মাস ধরে খোলাবাজারের সাথে ব্যাংকের ডলার মূল্যের এ বিশাল পার্থক্য বিরাজ করছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এর ফলে খোলাবাজারে ডলারের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে।
তবে একজন মানি চেঞ্জার ব্যবসায়ী গতকাল সোমবার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, খোলাবাজারে ডলারের সঙ্কট নির্ভর করে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে। দীর্ঘ দিন ধরে করোনার কারণে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এ কারণে মানুষের বিদেশে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া বন্ধ ছিল। একইভাবে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার জন্য বিদেশে যাতায়াতও তেমন করেনি। সবমিলে দেশে ডলারের চাহিদা কম ছিল। এ কারণে ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত ডলার ছিল। কিন্তু গত জুনের পর থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে। এতে বেড়ে গেছে পণ্য আমদানি। সেই সাথে বিদেশে ভ্রমণ ভিসা চালু হওয়ায় খোলাবাজারেও ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। কিন্তু বিপরীতে ডলারের আন্তঃপ্রবাহ কমে গেছে। আগে বিদেশে শ্রমিক যে হারে যাতায়াত করত এখন তা কমে গেছে। এতে এক দিকে যেমন কমে গেছে রেমিট্যান্স-প্রবাহ, তেমনি কমে গেছে ক্যাশ ডলার। সবকিছু মিলেই ডলারের দাম বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে নির্ধারিত দরে ডলার সরবরাহ করছে; কিন্তু খোলাবাজারে ডলার সরবরাহ করার কোনো উপকরণ নেই। এ কারণে ব্যাংকে একটি নির্ধারিত দরের মধ্যে ডলারের মূল্য বেঁধে দেয়া সম্ভব হলেও খোলাবাজারে তা সম্ভব হয়নি। ওই ব্যবসায়ী বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোতে ডলার সরবরাহ না করা হলে খোলাবাজারের চেয়েও ব্যাংকে ডলারের দাম বেড়ে যেত। তবে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেলে স্থানীয় বাজারে আবার চাহিদা কমে যাবে। তখন এমনিতেই খোলাবাজারে ডলারের দাম কমে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক গত আগস্ট থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করছে। যেমন গত আগস্টে ৩০ কোটি ৫০ লাখ ডলার, সেপ্টেম্বরে ৬৪ কোটি ১০ লাখ, অক্টোবরে ৫১ কোটি ৮০ লাখ ডলার নির্ধারিত মূল্যে ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করা হয়েছে। সবমিলে আগস্ট থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজস্ব রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করা হয়েছে ১৮২ কোটি ২০ লাখ।


আরো সংবাদ



premium cement