২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ক্রমবর্ধমান এলএনজি আমদানি ক্ষতিগ্রস্ত করবে জ্বালানি নিরাপত্তাকে

বিশেষজ্ঞদের অভিমত
-

জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশীয় উৎসের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, ক্রমবর্ধমান এলএনজি আমদানি বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বর্তমানে যে হারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হচ্ছে তা ১০ বছর অব্যাহত থাকলে ৯০ ভাগ জ্বালানির জন্য বিদেশী উৎসের ওপর নির্ভর করতে হবে, যা বছরে দুই হাজার কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে। স্থানীয় মুদ্রায় যা পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। এ জন্য নিজস্ব সম্পদ অনুসন্ধানের ওপর জোর দিতে হবে। নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আরিষ্কারের প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বর্তমানে মোট গ্যাস সরবরাহের ২০ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়, যেখানে দেশে প্রতিদিন ৪৬১ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে প্রায় ২৯৭ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। দেশের গ্যাস মহাপরিকল্পনা ২০১৭ অনুযায়ী, গড় সাত শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সামাঞ্জস্য রেখে জ্বালানি, শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন খাতের চাহিদা পূরণে দেশে গ্যাসের চাহিদা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫২৫ কোটি ৭০ লাখ ঘনফুট, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬২২ কোটি ৮০ লাখ ঘনফুটে উন্নীত হবে। পেট্রোবাংলার পূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশে স্থানীয়ভাবে গ্যাস উৎপাদন হ্রাস পাবে। বিদ্যুৎ, শিল্প-কারখানাসহ অন্যান্য খাতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে আমদানি বৃদ্ধি পাবে। ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ অব এলএনজি ইম্পোর্টারসে (জিআইআইজিএনএল) প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে এলএনজি আমদানি বৃদ্ধি করা দেশের মধ্যে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম।
দেশের জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, পেট্রোবাংলা হাইড্রোকার্বন খাতে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান পরিচালনা করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশ একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ গ্যাস এলএনজি হিসেবে বিদেশ থেকে আমদানি করি। যদি ১০ বছরের ভেতরে কোনো আবিষ্কার না হয় তাহলে আমাদের ৯০ শতাংশের বেশি গ্যাস বিদেশী উৎস থেকে আমদানি করতে হবে। ভবিষ্যৎ সঙ্কট এড়াতে সরকারকে ১৫ শতাংশ ড্রিলিং নিশ্চিত করতে হবে। এর মধ্যে পেট্রোবাংলা পাঁচ শতাংশ আর বাকি ১০ শতাংশ বিদেশী কোম্পানি থেকে। ড. ইজাজ আরো বলেন, এলএনজি আমদানি বাড়াতে স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাব থাকতে পারে। তবে অনুসন্ধান কাজ বাড়াতে সরকারকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পেট্রোবাংলার ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট ২৭টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২৮ দশমিক ২৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হবে বলে অনুমান করা হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮ দশমিক ২৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা হয়েছে। আর টু পি বিভাগে পুনরুদ্ধারযোগ্য গ্যাস অবশিষ্ট আছে ১০ দশমিক শূন্য ৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে ২০টি গ্যাসফিল্ডে ১০৫টি কূপ চালু রয়েছে। পেট্রোবাংলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারকে চার দশমিক ১৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে চার দশমিক ৪৬ শতাংশ মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি আমদানি করতে হয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন প্রায় দুই হাজার ৯৭৪ মিলিয়ন ঘনফুট; যার মধ্যে ৫৮১ মিলিয়ন ঘনফুট রিগ্যাসিফাইড ও অবশিষ্ট প্রায় দুই হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট আসে স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে।
পেট্রোবাংলা তিন মাসের গড় ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দামের প্রায় ১১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং প্রতি এমএমবিটিইউ শূন্য দশমিক ৪০ মার্কিন সেন্টে এলএনজি ক্রয় করেছে। আর এ অর্থ সরবরাহের ২৫ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে পেট্রেবাংলা নিয়মিত এলএনজি আমদানি শুরু করে।
দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি সরবরাহকারীরা করোনা পরবর্তী ব্যবসায়িক রিবাউন্ডের মধ্যে ‘অস্থির’ স্পট মার্কেট মূল্যকে নগদ করার জন্য আগামী বছরের জন্য বাংলাদেশে বিক্রয় প্রতিশ্রুতি হ্রাস করেছে। যদি স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি না পায়, এলএনজিতে স্বল্প-সরবরাহের প্রতিশ্রুতি আগামী বছর দেশের সামগ্রিক প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের ঘাটতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
আগামী বছর স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির কোনো পরিকল্পনা নেয়নি সরকার। যদিও ২০২১ সালে এ মার্কেট থেকে সরকার ১৬টি এলএনজি কার্গো আমদানি করেছে। তারা ‘অস্থির’ স্পট মার্কেটে ব্যবসাকে অগ্রাধিকার দেয় যেখানে মেয়াদি চুক্তির অধীনে দাম পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে তিন লাখ ৮০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সেই সময়ে প্রতি এমএমবিটিইউ মূল্য ছিল ২৯ দশমিক ৭৯ মার্কিন ডলার। তবে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় ডিসেম্বর পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে পণ্য না কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু জ্বালানি বিভাগ গ্যাস সঙ্কটের কথা বলে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
তবে বিশেষজ্ঞরা স্পট মার্কেট থেকে বাংলাদেশের এলএনজি ক্রয়ের সিদ্ধান্তের সাথে একমত নন। তারা বলছেন, স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার পরিস্থিতি বাংলাদেশের না। যদি বাংলাদেশ এলএনজি ক্রয় করতে চায় তাহলে সেটি করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশকে নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা অর্জনের দিকে নজর দিতে হবে।
দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রতিদিন ৭৫ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট এলএনজি প্রয়োজন। কিন্তু এর বিপরীতে দেশে এলএনজি সরবরাহের পরিমাণ প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি থাকে ৩৫ কোটি ঘনফুটের বেশি। তবে এ ঘাটতির পরিমাণও প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ তামিম বলেন, মৌলিক চাহিদা মেটানোর পর বাড়তি প্রয়োজন হলেই সাধারণত স্পট (মার্কেট) থেকে এলএনজি কেনা হয়। কিন্তু আমাদের মৌলিক চাহিদার ঘাটতি রয়েছে। তাই আমি মনে করি আমাদের স্পট থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। যখন আমরা পর্যাপ্ত গ্যাস উৎপাদন করতে পারব বা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে থাকতে পারব। তারপর যদি এটি ঘটে, আমরা স্পট থেকে কিনতে পারি। কিন্তু এখন আমাদের স্পট থেকে সরে যাওয়া উচিত।
তিনি বলেন, জ্বালানি মূল্যের সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ হওয়া উচিত ছিল। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থেকে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ অনেক আগেই নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা সেই সুযোগগুলো হাতছাড়া করেছেন যখন আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম অনেক কম ছিল।
তিনি বর্তমান গ্যাস সঙ্কটের জন্য পেট্রোবাংলাকে দায়ী করেন। কেননা ২০১৪ সালে প্রতিবেশী দেশের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর থেকে গেল সাত বছরে কোনো উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি এক আলোচনায় ড. তামিম বলেন, যদি আমদানির বর্তমান এ ধারা চলতে থাকে তাহলে বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশকে যেহেতু আমদানি করে ঘাটতি মেটাতে হয়। তাই ক্রয় করতে হবে। তবে আরো সুবিধাজনক উপায় ও বিকল্প ব্যবস্থার প্রচেষ্টা থাকতে হবে।
সম্প্রতি এক ওয়েবিনারে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জ্যৈষ্ঠ সচিব আনিসুর রহমান বলেন, স্পট মার্কেটে দাম এখন অস্বাভাবিক। কিন্তু এটি ডিসেম্বরের পর আর থাকবে না।
এ পরিস্থিতিতে জ্বালানি ঘাটতি মেটাতে এলএনজি নির্ভরতা কমিয়ে কয়লা উত্তোলনের ওপর গুরুত্বারোপ করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ এখন থেকে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আগামী তিন বছরে নিজস্ব কয়লা দিয়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারলে দেশের আমদানি নির্ভরতা কমবে।
ড. ইজাজ হোসেন বলেন, এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার সম্ভাবনা সরকারের বোঝা উচিত।
আর বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী আমদানি নির্ভর হতে চাইলে ২০৩০ সাল নাগাদ কয়লা, এলএনজি ও বিদ্যুতের মোট চাহিদার ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি আমদানি করে টিকে থাকতে পারব? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সেই ব্যয় সামলানোর মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাংলাদেশের এখনো নেই।


আরো সংবাদ



premium cement