১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

১৩ আসামির মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবন ১৯ জনের

আমিনবাজারে ৬ ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা
-

সাভারের আমিনবাজারে বড়দেশী গ্রামে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার চাঞ্চল্যকর মামলায় আসামিদের মধ্যে ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ২০১১ সালের ১৭ জুলাই পবিত্র শবেবরাতের রাতে মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে। ১০ বছর আগের ওই ঘটনা পুরো দেশকে স্তম্ভিত করে দেয়। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ইসমত জাহান এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
মামলায় অভিযুক্ত ৬০ আসামির মধ্যে তিনজন বিচার চলাকালে মারা যান। বাকি ৫৭ আসামির মধ্যে ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি তাদের সবাইকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। অন্য একটি ধারায় এই ১৩ জনকে আরো সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেনÑ আবদুল মালেক, সাঈদ মেম্বার, আবদুর রশিদ, ইসমাইল হোসেন রেফু, নিহার ওরফে জমশের আলী, মীর হোসেন, মজিবর রহমান, আনোয়ার হোসেন, রজ্জব আলী সোহাগ, আলম, রানা, আ: হামিদ ও আসলাম মিয়া।
এ ছাড়া ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশ দেন আদালত। অন্য একটি ধারায় তাদের সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা হলেনÑ শাহীন আহমেদ, ফরিদ খান, রাজিব হোসেন, ওয়াসিম, সাত্তার, সেলিম, মনির হোসেন, আলমগীর, মোবারক হোসেন, অখিল খন্দকার, বশির, রুবেল, নূর ইসলাম, শাহাদাত হোসেন, টুটুল, মাসুদ, মোখলেস, তোতন ও সাইফুল।
আর অভিযোগের সাথে সম্পৃক্ততা প্রমাণিত না হওয়ায় মামলার বাকি ২৫ আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। তারা হলেনÑ বাদশা মিয়া, সালাম, আফজাল, নিজাম, রহিম, শাহজাহান, সুলতান, সোহাগ, লেমন, সায়মন, এনায়েত, দুলাল, হায়দার, খালেক, ইমান আলী, আলম, আমিন, সালেহ আহমেদ, শামসুল হক, রহিম-২, মো: সেলিম, সানোয়ার, আনোয়ার ও সাইফুল। বিচার চলাকালে মৃত তিনজন হলেন- কবির হোসেন, রাশেদ ও সাব্বির আহমেদ
এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ভিকটিমদের পরিবার। নিহত কামরুজ্জামানের বাবা আব্দুল কাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, রায়ে আমি সন্তুষ্ট, দীর্ঘদিন পরে হলেও রায় হয়েছে। প্রকৃত দোষী আসামিদের শাস্তি হবে, এই প্রত্যাশা ছিল আমাদের। রায় যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়। নিহত ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশের বাবা মজিবর রহমান এবং ইব্রাহিম খলিলের বাবা আবু তাহেরও রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
অন্য দিকে রায়ের পর আদালতে উপস্থিত দণ্ডিত কয়েকজন আসামির স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের কয়েকজন এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথাও বলেন।
রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলা পরিচালনা করেন আইনজীবী আব্দুল মতিন, আনন্দ চন্দ্র বিশ্বাস, শাকিলা জিয়াসমিন মিতু ও ফারুক আহাম্মদ। আব্দুল মতিন বলেন, ‘এটি একটি বৃহৎ ঘটনার মামলা। আমরা অনেক দিন ধরে অনেক কষ্ট করে মামলার ৯২ জনের মধ্যে ৫৫ জন সাক্ষীকে আদালতে এনে সাক্ষ্য করিয়েছি। আমরা রায়ে সন্তুষ্ট।’ সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর শাকিলা জিয়াসমিন মিতু বলেন, আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রত্যাশা করেছিলাম আসামিদের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। নিহতদের পরিবারের সদস্যরা ন্যায়বিচার পেয়েছেন। রায় দ্রুত কার্যকর হবে বলে প্রত্যাশা করছি।
অন্য দিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবী শিউলি আক্তার রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, এই রায়ে আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। রায়ের কপি হাতে পেলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিব।
নিহত ছয় ছাত্র হলেনÑ ধানমন্ডির ম্যাপললিফ স্কুলের এ-লেভেলের ছাত্র শামস রহিম শাম্মাম, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম খলিল, বাঙলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশ, তেজগাঁও কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র টিপু সুলতান, মিরপুরে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সিতাব জাবীর মুনিব এবং বাঙলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র কামরুজ্জামান।
পুলিশের অভিযোগপত্র পেয়ে ২০১৩ সালে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ৬০ আসামির বিচার শুরু করেন আদালত। সাক্ষ্য আর যুক্তিতর্ক শেষ করে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসতে লেগে যায় আট বছর। রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ২২ নভেম্বর রায়ের দিন ঠিক করে দেন বিচারক। একইসাথে জামিনে থাকা ৪২ আসামির জামিন বাতিল করে সেদিন তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। বাকি ১৬ আসামিকে পলাতক দেখিয়ে মামলার বিচারকাজ চলে।
ঘটনাক্রম : ২০১১ সালের ১৭ জুলাই রাতে বড়দেশী গ্রামের কেবলার চরে বেড়াতে যান সাত তরুণ। তারা সবাই ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তেন। স্থানীয় কিছু লোক তাদের ধরে ডাকাত আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করে। তাতে একজন প্রাণে বাঁচলেও ছয়জন মারা যান। হামলায় গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান কেবল আল-আমিন। পরে তার কাছ থেকে সেই রাতের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়।
এ ঘটনার পর প্রথমে ডাকাতির অভিযোগ এনে আল-আমিন এবং তার নিহত ছয় বন্ধুর নামে একটি মামলা করেন স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী মালেক। পরে আলোচিত ওই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তে বেরিয়ে আসে, নিহত ছাত্ররা ডাকাত ছিল না এবং হত্যা এড়াতে পুলিশ যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। মালেকের অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় তার মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগে মালেকের বিরুদ্ধে মামলা করারও নির্দেশ দেন আদালত।
অন্য দিকে ছাত্র অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরোধিতার মুখে পুলিশ বাদি হয়ে অজ্ঞাত গ্রামবাসীকে আসামি করে সাভার থানায় আরেকটি মামলা করে। ছয় ছাত্রকে হত্যা মামলার তদন্তভার থানা পুলিশের হাত থেকে সিআইডি এবং পরে আদালতের নির্দেশে র্যাবের হাতে যায়। পরে র্যাবের সহকারী পরিচালক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ উদ্দিন ২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারি সেই মালেকসহ ৬০ জনকে আসামি করে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দেন। এরপর মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ইসমত জাহানের আদালতে আসে। ২০১৩ সালের ৮ জুলাই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ৬০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এ ছাড়া ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একমাত্র ভিকটিম আল-আমিনকে ডাকাতি মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এ মামলায় ১৪ জন আসামি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। বিচারকালে ৫৫ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়।


আরো সংবাদ



premium cement