২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

হুমকির মুখে তৈরী পোশাকের সহযোগী শিল্প

এইচএনএমসহ অন্য অফিসগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে চীনে
-

নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে দেশের তৈরী পোশাকের সহযোগী শিল্পগুলো। এক দিকে মার্চেন্ডাইজারদের কমিশন বাণিজ্য, অপর দিকে পণ্য রফতানির আয় সময় মতো না পাওয়ায় অর্থ সঙ্কটে ভুগছে এসব প্রতিষ্ঠান। ফলে অনেকেই এখন ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছে। এটা অব্যাহত থাকলে সহযোগী এসব পণ্য আবারো আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। এতে এক দিকে দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাবে, অন্য দিকে বেড়ে যাবে বেকারত্ব। এমনি পরিস্থিতিতে সহযোগী শিল্পগুলো রক্ষা এবং বিদ্যমান সমস্যা উত্তরণে বিজিএমইকে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, তৈরী পোশাকের অপরিহার্য পণ্য বোতাম, কার্টন, লেভেলসহ অন্যান্য পণ্য (গার্মেন্ট এক্সেসরিজ) গোড়ার দিকে কোরিয়া, পরে চীন, হংকং থেকে আমদানি করা হতো। এতে প্রতি বছর বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হতো। অপর দিকে এসব সহযোগী পণ্যের অভাবে সময়মতো তৈরী পোশাক রফতানি বাধাগ্রস্ত হতো। যেমন- একটি রফতানি আদেশে যে পরিমাণ বোতাম দরকার ওই পরিমাণ বোতাম আমদানি করা হতো। কিন্তু কোনো কারণে নির্দিষ্ট বোতাম কম হলো। পরে তা আবারো আমদানি করে পোশাক তৈরি করা হতো। একটি সহযোগী পণ্য কম থাকলে তৈরী পোশাক সময়মতো রফতানি করা যেত না। এতে সময়ের যেমন অপচয় হতো, তেমনি ক্ষতিপূরণও গোনতে হতো। কিন্তু ৯০ দশক থেকে এসব সহযোগী পণ্য দেশেই উৎপাদন হতে থাকে। এতে একদিকে এসব পণ্য আমদানিতে যেখানে বিদেশী মুদ্রা ব্যয় করতে হতো, সেখানে দেশে তৈরি হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়। অপর দিকে এসব সহযোগী পণ্যের সরবরাহের কারণে সময়মতো পোশাক রফতানিতে বাধা কেটে যায়। জানা গেছে, তৈরী পোশাকে ব্যবহৃত এসব পণ্য উৎপাদনের জন্য দেশে গড়ে উঠেছে প্রায় দুই হাজার শিল্পকারখানা। আর এর সাথে জড়িত রয়েছেন প্রায় ৮ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী।
সহযোগী পণ্যগুলো দেশে উৎপাদিত হওয়ায় স্থানীয় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে কেনার জন্য ৯০ দশকের এইচএনএম, বার্নার, সিএনএসহ বড় বড় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে অফিস খোলে। প্রথমে সংশ্লিষ্ট দেশের কর্মকর্তারা এসব অফিস পরিচালনা করত। তখন শুধু বিশেষ কোনো পণ্য আমদানি করা হতো। আর তৈরী পোশাকের সব সহযোগী পণ্য স্থানীয় বাজার থেকেই সরবরাহ করা হয়।
৯০ দশকের শেষের দিকে এসব বিদেশী অফিস পরিচালনা করতে নিচের দিকের কিছু কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ থেকে নিয়োগ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, তখন থেকেই মূলত দুর্নীতির সূত্রপাত। শুরু হয় কমিশন বাণিজ্য। নিচের দিকের কর্মকর্তাদের কমিশন না দিলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালানো হতো। শুধু তাই নয়, রফতানি আদেশ বাতিল করে অন্য কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এসব সহযোগী পণ্য সরবরাহ করা হতো।
নিচের দিকের কর্মকর্তাদের এসব দুর্নীতি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোর প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ যেতে থাকে। তখন প্রধান কার্যালয় থেকে কার্যালয়গুলোকে কড়া নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। একপর্যায়ে অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও নজরদারির মধ্যে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু বায়িং হাউজগুলোর মার্চেন্ডাইজার এবং গার্মেন্ট মাচেন্ডাইজারদের দৌরাত্ম্য এখনো বহাল রয়েছে। সহযোগী শিল্পের উদ্যোক্তারা মার্চেন্ডাইজারদের দুর্নীতি বন্ধ করতে নিচের কর্মকর্তাদের এক সাথে দুই বছরের বেশি কাজে বহাল না রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সাথে তাদের বিরুদ্ধে নজরদারি বাড়ানোরও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
একজন শিল্প উদ্যোক্তা জানান, মার্চেন্ডাইজারদের দুর্নীতির পাশাপাশি কিছু তৈরী পোশাক কারখানা মালিকদের কারণেও সহযোগী শিল্পের উদ্যোক্তাদের হয়রানির মাত্রা বেড়ে চলেছে। অনেকেই পণ্য সরবরাহ করার পর মাসের পর মাস মূল্য পরিশোধ করছেন না। এ দিকে শ্রমিকদের বেতনভাতা, এসব পণ্যের কাঁচামাল আমদানির ব্যয় পরিশোধ করতে হচ্ছে। কিন্তু মাসের পর মাস পণ্যমূল্য আটকে থাকায় অনেকেরই অর্থ সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে। অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এক দিকে গত দুই বছরের করোনা প্রভাব, অপর দিকে সময়মতো পণ্য মূল্য না পাওয়ায় অনেকেই দিশেহারা। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তারা বিজিএমইএর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এ দিকে আরেক উদ্বেগের কারণ হলো এইচএনএমসহ ভালো কিছু কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ চীনে চলে যাওয়া। সংশ্লিষ্ট এক উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, দেশীয় মার্চেন্ডাইজারদের দুর্নীতি এবং ব্যয় কমানোর জন্য বড় কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণ চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। আর চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে তাদের পণ্যের আদেশ বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ থেকেও চলে যাবে। তখন স্থানীয় এসব পণ্যের চাহিদা কমে যাবে। এমন হলে দেশীয় অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। সবমিলে তৈরী পোশাকের সহযোগী শিল্পগুলো হুমকির মুখে পড়ে গেছে।
উদ্যোক্তারা জানান কার্টন, প্যাকেজিং ও লেভেল না হলে তৈরী পোশাক রফতানি কল্পনাই করা যায় না। আবার তৈরী পোশাক শ্রমিকদের যে হারে বেতনভাতা দেয়া হয় সহযোগী এ দু’টি শিল্প শ্রমিকদেরও সেই হারে বেতনভাতা দেয়া হয়। বিদ্যুৎ, গ্যাসবিলসহ অন্যান্য ইউটিলিটি বিল সমহারে বাড়ে। করোনার প্রভাবে তৈরী পোশাক যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারাও সেইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বর্তমানে দেশে প্রায় এক হাজার ৭০০ প্যাকেজিং ফ্যাক্টরি রয়েছে। চালু রয়েছে প্রায় এক হাজার ২০০টি। এতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত আছেন। কিন্তু তৈরী পোশাকের মতো এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রণোদনা দেয়া হয়নি। এর ওপর সময়মতো পণ্যমূল্য না পাওয়ায় তারা চরম অর্থসঙ্কটে ভুগছেন। ইতোমধ্যে অনেকের ঋণ করার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলছে। এতে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে অনেক কারখানা। পরিস্থিতি উত্তরণে তারা সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।


আরো সংবাদ



premium cement