১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
জ্বালানি তেল নিয়ে সিপিডি

মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক ও ভুুল সিদ্ধান্ত

তেলের মূল্যের সাথে সামঞ্জস্যহীন অযৌক্তিক ভাড়া বৃদ্ধি; সরকারিভাবে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতির তথ্য অবাস্তব
-

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিকে সরকারের রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত ও অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের সুপারিশ জানিয়ে সিপিডি বলেছে, শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, অর্থনৈতিক বিবেচনায়েও এই সিদ্ধান্ত সরকারের জন্য সঠিক হয়নি। তবে তাৎক্ষণিকভাবে ভর্তুকির কিছু অর্থ সাশ্রয় করতে গিয়ে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহার করে আগের মূল্যে ফিরে যাওয়ার সুপারিশ করেছে তারা। তেলের মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও লঞ্চের ভাড়া বেড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ও বাড়বে। কৃষি উৎপাদনেও খরচ বেড়ে যাবে। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। তেলের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব ছিল।
‘জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি : কতটা জরুরি ছিল’ শীর্ষক গতকাল বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিমত জানিয়েছে সিপিডি। মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিত মূল্যায়ন করেছে সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষকদের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশের উন্নয়নে স্বাধীন পর্যালোচনা দল। অনুষ্ঠানের শুরুতে নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। বক্তব্য রাখেন সংস্থার সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।
সিপিডির মূল উপস্থাপনায় বলা হয়, জ্বালানি তেল একটি কৌশলগত পণ্য। অর্থনীতির নানা খাতে এর সরাসরি প্রভাব আছে। করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পরিস্থিতিতে দাম বাড়ানো যৌক্তিক হয়নি। শুল্ক প্রত্যাহার করে বা ভর্তুকি দিয়ে বিপিসির ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। অর্থনীতির জন্য বোঝা তৈরি হলে বিভিন্ন দেশের সরকার এটি করে থাকে। আগামী বছর বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে এলে সাথে সাথে তেলের দাম না কমিয়ে বিপিসি এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারত। সিপিডির সুপারিশে বলা হয়, বিভিন্ন দেশে জ্বালানি তেলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করা হয়। তাই দেশেও মূল্য সমন্বয়ের প্রক্রিয়া ঠিক করা দরকার। এর সাথে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) যুক্ত করা দরকার।
সিপিডির প্রবন্ধে বলা হয়, বিশ্ববাজারে তেলের দাম নিয়মিত ওঠানামা করে। ২০১৬ সালে প্রতি ব্যারেল ৪২ ডলার হওয়ার পর দেশে ডিজেলের দাম কমিয়ে ৬৫ টাকা করা হয়। এরপর করোনার প্রভাবে গত বছর দাম ২৩ ডলারে নেমে এলেও দেশে কমানো হয়নি। এ বছর ৮৩ ডলারে পৌঁছালে দেশে এক লাফে ১৫ টাকা বাড়ানো হয় প্রতি লিটারে। অথচ গত সাত বছরে বিপিসি মুনাফা করেছে ৪৩ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। এর আগে ২০০৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বিপিসি লোকসান করেছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। সব মিলেও লাভে আছে বিপিসি। সিপিডি বলছে, জ্বালানি তেলে ৩৪ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও লভ্যাংশ মিলে প্রতি বছর বিপুল টাকা জমা হচ্ছে সরকারি কোষাগারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। এর আগের অর্থবছরে এটি ছিল ৯ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।
তারা বলছে, তেলের মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাথে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, লঞ্চে ভাড়া বেড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ও বাড়বে। কৃষি উৎপাদনেও খরচ বেড়ে যাবে। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। করোনার প্রভাবে মানুষের আয় কমেছে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের চড়া দামের কারণে আগে থেকেই ভোক্তারা চাপে আছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। সরকারিভাবে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির যে তথ্য দেয়া হয়, তা বাস্তবের সাথে মিল নেই। সব মিলে সাধারণ মানুষের জন্য অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রার ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে হয়তো বিত্তবানদের ওপর খুব একটা প্রভাব পড়বে না। কিন্তু যারা দরিদ্র এবং যারা নতুন করে দরিদ্র হয়েছে, যারা কোভিড আক্রান্ত অর্থনীতিতে নতুন করে রিকোভারির চেষ্টার মধ্যে রয়েছে, তাদের ওপর যে প্রভাব পড়বে, আমরা যদি ন্যায্যতার কথা বলি সেই ন্যায্যতার দিক থেকেও এটা (জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি) একটা অন্যায্য পদক্ষেপ। ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মুনাফার টাকা বিপিসির হাতে থাকলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। উদ্বৃত্ত অর্থ সরকার নিয়ে যাওয়ায় বিপিসি সক্ষমতা হারিয়েছে। আবার তেলের দামের সাথে সামঞ্জস্য না রেখে অযৌক্তিকভাবে বেশি হারে পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব ছিল।
প্রতিবেশী দেশের জ্বালানি তেলের সাথে তুলনার ব্যাপারে সিপিডির কাছে জানতে চাইলে সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জম বলেন, রাজনৈতিকভাবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হয়নি। এটি সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত। দেশে বিদ্যমান সরকার নিয়ন্ত্রিত মূল্য কাঠামোর সাথে হঠাৎ অন্য দেশের সাথে তুলনা করলে হবে না। ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য কাঠামোর দিকে যাওয়ার দরকার আছে। তবে করোনা মহামারীর এই মুহূর্তে নয়।
বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির ব্যাখ্যা নিয়ে সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, অন্যদেশে যখন দাম কম ছিল, দেশে তখন কমানো হয়নি কেন? করোনার মধ্যেও জনগণের কাছ থেকে সরকার জ্বালানি তেলে বাড়তি টাকা নিয়েছে। সেই টাকায় এখন ঘাটতি পূরণ করার কথা। কিন্তু সরকার জনগণের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেছে। সামাজিক ন্যায়বিচারের দিক থেকে সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি।


আরো সংবাদ



premium cement