পীরগঞ্জ হামলায় ছাত্রলীগ নেতা সৈকতসহ দুই অভিযুক্ত গ্রেফতার
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২৪ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
রংপুরের পীরগঞ্জ জেলেপল্লীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার অন্যতম হোতা সৈকত মণ্ডল ও সহযোগী রবিউল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র্যাব সৈকত মণ্ডলের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় না পাওয়ার কথা জানালেও এস এম সৈকত মণ্ডল (২৪) একজন ছাত্রলীগ নেতা বলে জানা গেছে। তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ দর্শন বিভাগ ছাত্রলীগের সহসভাপতি। তবে হামলা ঘটনার পর গত সোমবার তাকে বহিষ্কার করা হয়। সৈকত মণ্ডল উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের চেরাগপুর গ্রামের রাশেদুল মণ্ডলের ছেলে। তাকে বহিষ্কারের বিষয়ে কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুজ্জামান সিজার জানান, সৈকতকে গত ১৮ অক্টোবর ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অন্য দিকে রবিউল ইসলাম বটেরহাট জামে মসজিদের ইমাম এবং সে খেজমতপুর গ্রামের মৌলভী মো: মোসলেম উদ্দিন বাবুর ছেলে।
এ দিকে পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ার ঘটনার এক দিন পর (১৮ অক্টোবর) সৈকতকে ছাত্রলীগের কমিটি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রংপুর মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ আসিফ হোসেন।
তিনি জানান, চার বছর আগে ২০১৭ সালের ৮ মে দর্শন বিভাগের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে সহসভাপতি পদে ছিলেন সৈকত মণ্ডল। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যকলাপের অভিযোগ পাওয়া যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ অক্টোবর তাকে ছাত্রলীগের কমিটি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ছাত্রলীগের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই তার।
মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আরো বলেন, সৈকত মণ্ডলের বাড়ি পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামে। সম্প্রতি এলাকায় অবস্থানকালে তিনি দলীয় আদর্শবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত হন। বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে উসকানি ও বিদ্বেষমূলক পোস্ট ও মন্তব্য করতেন। তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্টের অপচেষ্টার অভিযোগ পাওয়ায় ১৮ অক্টোবর তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এ দিকে সৈকত মণ্ডলকে কমিটি থেকে অব্যাহতি দেয়ার বিষয়ে কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুজ্জামান বলেন, আমরা যখনই তার বিরুদ্ধে ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্ট ও কমেন্টস করার অভিযোগ পেয়েছি, সাথে সাথে তাকে কমিটি থেকে বহিষ্কার করেছি। একই সাথে দলের কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতাদের বিষয়টি জানিয়েছি।
পীরগঞ্জে হামলার ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না, জানতে চাইলে সিজার বলেন, এটিও প্রশাসন তদন্ত করে জানাবে। তবে আমরা শুনেছি, সৈকত ঘটনার আগ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এসব নিয়ে লেখালেখি করত। এটি আমাদের ছাত্রলীগের রাজনীতির পরিপন্থী। এ কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
সৈকতের গ্রামের বাড়ি মাঝিপাড়া এলাকায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৈকতের বাবা রাশেদুল ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত নন। তবে সৈকতের দাদা আবুল হোসেন মণ্ডল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদে রয়েছেন। চাচা রেজাউল করিমও সংশ্লিষ্ট ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। সৈকত কারমাইকেল কলেজের দর্শন বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা থাকলেও আগে থেকেই ছিলেন সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন।
স্থানীয়দের দাবি, ঘটনার পর সৈকত মণ্ডল, রবিউল ইসলামসহ অনেকেই গ্রাম থেকে আত্মগোপনে চলে যান। গতকাল হঠাৎ করেই তারা টেলিভিশনে সৈকত ও রবিউলের গ্রেফতার হওয়ার খবর জানতে পারেন।
তবে তার পরিবারের দাবি, সৈকত মণ্ডল নির্দোষ এবং ঘটনাক্রমে ষড়যন্ত্রের শিকার। পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করার দাবি করে তার চাচা রেজাউল করিম বলেন, আমার ভাতিজা সৈকত মণ্ডল ঘটনার দিন দক্ষিণ মাঝিপাড়ায় অবস্থান করছিল। সেখানে পুলিশ ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম ছিলেন। সেখানে সৈকত উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছে। সবাইকে বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করে পরিতোষ সরকারের ধর্ম অবমাননার বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে অনুরোধ করে। এ কারণে পুলিশ তখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরিতোষকে গ্রেফতারের আশ্বাস দেয়। কিন্তু এরই মধ্যে উত্তর মাঝিপাড়ায় আগুন লাগে। এর সাথে সৈকতের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমার ভাতিজা নির্দোষ ও নিরপরাধ।
সৈকতের দাদা আবুল হোসেন মণ্ডল বলেন, আমরা নয়া আওয়ামী লীগ করি না। এখন তো অনেক হাইব্রিড নেতা। আমি বহু পুরনো মানুষ। সেই বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। যখন এলাকায় কেউ আওয়ামী লীগ করার সাহস পায় নাই, তখন থেকেই আওয়ামী লীগ করছি। নৌকা ছাড়া কিছু বুঝি না। আমার নাতিও ছাত্রলীগ করে। এটা নতুন ষড়যন্ত্র, তদন্ত করা দরকার।
সৈকতের মা আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, ঘটনার পর চেয়ারম্যান তাদেরকে সাবধানে থাকতে বলায় স্বামী আর সন্তান (সৈকত মন্ডল)সহ পলাশবাড়িতে যাই। তিরিন বলেন, তার ছেলে সৈকত কোনো অন্যায় করে নাই।
গত শুক্রবার রাতে র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১৩ এর একটি আভিযানিক দল টঙ্গী এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে।
র্যাবের দাবিÑ ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকেই সৈকত এমন কাজ করেছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে একটি ‘দুর্বল সময়ের’ জন্য অপেক্ষা করছিলেন সৈকত। এ ছাড়া তার ফেসবুকে ফলোয়ার বাড়ানো এবং সামাজিক অবস্থান সুদৃঢ় করতে উসকানিমূলক পোস্ট দেন। আর তার নির্দেশে রবিউল ইসলাম মসজিদের মাইক ব্যবহার করে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে জনতাকে উত্তেজিত করেন। তারা দু’জনই সে দিনের হামলার ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন।
রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে গতকাল শনিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, পীরগঞ্জের বড় করিমপুরে পরিতোষ সরকার ও উজ্জ্বল নামে দুই তরুণের মধ্যে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল। এর জের ধরে পরিতোষের ধর্ম নিয়ে উজ্জ্বল কটূক্তি করেন। পরে পরিতোষ ফেসবুক মেসেঞ্জারে উজ্জ্বলের ধর্ম নিয়ে পাল্টা মন্তব্য করেন। পরিতোষের ওই মন্তব্য ফেসবুকে পোস্ট করেন উজ্জ্বল। উজ্জ্বলের ওই পোস্ট সৈকত আবার তার নিজের ফেসবুক পেজে ছড়িয়ে দেন। পাশাপাশি, কুমিল্লার ঘটনার পর থেকেই সৈকত নানা উসকানিমূলক পোস্ট দিচ্ছিলেন। সৈকত ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়িয়ে ও উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে লোকজনকে উত্তেজিত করে। ঘটনার দিন তার সহযোগী রবিউল ইসলাম একটি মসজিদ থেকে মাইকিংয়ের মাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে স্থানীয় লোকজনকে একত্র করে। এর পরই হামলা চালানো হয়।
র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, গত ১৭ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্টকে কেন্দ্র করে রংপুর পীরগঞ্জের বড় করিমপুর গ্রামে দুর্বৃত্তরা বেশ কয়েকটি বাড়িঘর, দোকানপাট ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। ওই ঘটনায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের অভিযোগে রংপুরের পীরগঞ্জ থানায় তিনটি মামলা হয়। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব-১৩ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসে। তাদের তথ্যে হামলায় নেতৃত্বদান ও ঘটনা সংঘটিত করার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে জানা যায়। ওই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় টঙ্গী থেকে রংপুরের ঘটনার অন্যতম হোতা সৈকত মণ্ডল ও রবিউল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়।
সৈকত মণ্ডল ছাত্রলীগের কোনো পদে ছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সৈকত রংপুরের একটি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী। রংপুরে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে নিজে প্রচার করতে পারেন কিন্তু তার কোনো রাজনৈতিক পোস্ট-পদবি ছিল না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তার কোনো সম্পৃক্ততাও আমরা পাইনি।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতার রবিউল সৈকতের কথায় পাশের মসজিদ থেকে মাইকিং শুরু করেন। এরপর তিনি মাইকিংয়ের দায়িত্ব তার কাজিনকে দেন। মাইকিংয়ের ভাষা ছিল এমন-পরিতোষ নামের যে ছেলেটি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে কাবা ঘর অবমাননা সম্পর্কে এতে করে এলাকাবাসী ও তৌহিদি জনতা একত্র হন। সৈকত মণ্ডলের মতো লোকজন সবাইকে উত্তেজিত করে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটান।
প্রসঙ্গত, গত ১৭ অক্টোবর রাতে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুর মাঝিপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গ্রামটির ১৫টি পরিবারের ২১টি বাড়ির সবকিছু আগুনে পুড়ে গেছে। সব মিলিয়ে অন্তত ৫০টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। হামলাকারীরা গরু-ছাগল, অলঙ্কার, টাকাও নিয়ে গেছেন বলে দাবি ক্ষতিগ্রস্তদের। এ ঘটনায় পীরগঞ্জ থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে তিনটি মামলা করা হয়েছে। এতে গত ছয় দিনে ৫৮ জন গ্রেফতার হয়েছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা