২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ছোট গ্রাহকও ফেরত দিতে পারছে না প্রণোদনার ঋণ

নীতিমালা শিথিলের পরও নতুন বিনিয়োগের গতি মন্থর
ছোট গ্রাহকও ফেরত দিতে পারছে না প্রণোদনার ঋণ - ছবি : নয়া দিগন্ত

বড় গ্রাহকদের মতো ছোটগ্রাহকরাও প্রণোদনার ঋণ ফেরত দিতে পারছেন না। করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবে আয় কমে গেছে। অনেক চালু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ঋণ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা কমে গেছে অনেকের। এ দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিলের পরেও নতুন বিনিয়োগে মন্থরতা কাটছে না। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ছোট গ্রাহকদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে এক হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার পৌনে আট শতাংশ মাত্র। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ভালো গ্রাহকরা ব্যাংকে আসছেন না। যারা ঋণ নিতে আসছেন তাদের বেশির ভাগই ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না। সবমিলেই চলতি অর্থবছরের ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্ধেকও বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে গত বছর ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। বিতরণ করা হয়েছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৭৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী প্রণোদনার ঋণ এক বছরের মধ্যে ফেরত দিতে হবে। কোনো গ্রাহক এক বছরের মধ্যে ফেরত দিলে তিনি সুদের ওপর ৫ শতাংশ ছাড় পাবেন। নীতিমালা অনুযায়ী কোনো গ্রাহক প্রথম বছর ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরের বছর ওই ঋণ পরিশোধের জন্য সময় নিতে পারেন। তবে পরের বছর থেকে সুদহারের ওপর কোনো ছাড় পাবেন না। অর্থাৎ ৯ শতাংশ হারে সুদ পরিশোধ করতে হবে। গত প্রায় দেড় বছর ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দার কারণে ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় মার খেয়ে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। এ কারণে অনেকেই ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করতে পারছেন না। যারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তারাও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে গত বছর যারা ঋণ নিয়েছিলেন তাদের অনেকেই ঋণ ফেরত দিতে পারছেন না। এ কারণে অনেকেই ঋণ পরিশোধের জন্য আরো সময় চাইছেন।

এ দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী গত বছরের মতো চলতি অর্থবছরেও ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ভালো গ্রাহক না পাওয়ায় ব্যাংকগুলো কাক্সিক্ষত হারে ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিল করে পুরনো গ্রাহকদের ঋণ দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়।
এক নির্দেশনায় বলা হয়, চলতি মূলধনের যে অংশটুকু গত বছর গ্রাহকরা নিতে পারেননি, অবশিষ্টাংশ এবার তা নিতে পারবেন পুরনো গ্রাহকরা। আবার বলা হয়েছিল, কোনো গ্রাহক একবার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ নিলে দ্বিতীয়বার আর ঋণ নিতে পারবেন না। এ কারণে অনেকের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এ প্যাকেজ থেকে ঋণ নিতে পারছেন না। ব্যাংকারগুলো জানিয়েছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই ঋণ নিয়ে তা ইতোমধ্যে ফেরত দিয়েছেন।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, চলতি বছরে আবারো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এবার সবচেয়ে জটিলতা যেটি দেখা দিয়েছে, তা হলো নতুন নতুন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে ঋণ বিতরণের ১২ মাসের পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যেমনÑ কোনো ব্যাংকের ৬০০ কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রতি মাসে ৫০ কোটি টাকা করে ঋণ বিতরণ করতে হবে। কিন্তু কাক্সিক্ষত হারে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা না পাওয়ায় তারা প্রতি মাসে ১০ কোটি টাকারও ঋণ বিতরণ করতে পারছেন না। এভাবে ঋণ বিতরণের যে লক্ষ্যমাত্রা তা অর্জন নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন তারা। বিষয়টি ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকারদের চলমান অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে নীতিমালা শিথিল করা হয়। বলা হয়, পুরনো গ্রাহকরা তাদের চলতি মূলধনের অবশিষ্টাংশ ঋণ নিতে পারবে। যেহেতু নতুন উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না, সে কারণে যারা ইতোমধ্যে শত ভাগ চলতি মূলধন ভোগ করেননি, বিশেষ করে প্রথমে ৩০ শতাংশ ও পরে ৫০ শতাংশ চলতি মূলধনের জোগান পেয়েছেন তাদেরকে শতভাগ চলতি মূলধন জোগানোর আওতায় আনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিলের পরেও কাক্সিক্ষত হারে ঋণ বিতরণ করতে পারছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ১ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে এ খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে মাত্র এক হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় পৌনে আট শতাংশ। যেখানে তিন মাসে বিতরণ করার কথা ছিল মোট লক্ষ্যমাত্রার ২৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যেভাবে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে, তাতে চলতি অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও বিতরণ করা সম্ভব হবে না।

তদারকি বৃদ্ধির কারণে ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর সতর্কতা : গত বছরে প্রণোদনার অর্থ বিশেষ করে বড় গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণ করা ঋণের বড় একটি অংশ নিয়ে নয়ছয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। চলতি মূলধনের আওতায় ঋণ নিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণের কাজে ব্যয় না করে কেউ কেউ পুরনো ঋণ পরিশোধ করেছেন। কেউ কেউ প্রণোদনার ঋণের অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। কেউবা জমি ফ্ল্যাট কিনেছেন। আবার কারো কারো বিরুদ্ধে প্রণোদনার অর্থ বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির আড়ালে পাচার করার অভিযোগও উঠেছে। এজন্য প্রণোদনার ঋণের অর্থ সঠিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা তদারকি করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে। বিশেষ করে এবার প্রণোদনার অর্থ কাদেরকে দেয়া হচ্ছে, ঋণের অর্থ কী কাজে ব্যয় করছেন তার বিস্তারিত বিবরণী বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে দাখিল করতে হচ্ছে। একই সাথে একজন গ্রাহক এক বছরের বেশি সময়ের জন্য সুদের ভর্তুকি নিচ্ছেন কিনা তাও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তদারকি করা হচ্ছে। সবমিলে প্রণোদনার অর্থ ছাড়ে তদারকি বাড়ানোর কারণে ব্যাংকগুলো অধিক সতর্কতার সাথে এবার ঋণ বিতরণ করছে। বিশেষ করে গ্রাহককে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে এবার ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। এর প্রভাবে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কমে গেছে।

১০ শতাংশের বেশি গ্রাহককে ঋণ বিতরণ করা হয়নি : বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশে যে পরিমাণ ক্ষুদ্রগ্রাহক রয়েছেন গেল বছর তার ১০ শতাংশকেও ঋণ বিতরণ করা হয়নি। এ হিসাব মতে ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্রগ্রাহক এখনো প্রণোদনার সুবিধার আওতার বাইরে রয়েছে। কেন তাদেরকে প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় এনে ঋণ বিতরণ করা যাচ্ছে না এমন এক প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই সূত্র জানিয়েছে, বলা চলে ক্ষুদ্রগ্রাহকদের ১০ শতাংশই ভালো ও প্রথম সারির গ্রাহক। এসব গ্রাহকের বেশির ভাগকেই গত বছর এ কর্মসূচির আওতায় আনা গেছে। কিন্তু বাকি ৯০ শতাংশ গ্রাহক দ্বিতীয় তা তৃতীয় সারির। যেখানে প্রথম সারির গ্রাহকরাই ব্যাংকের ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারছেন না, সেখানে দ্বিতীয় সারির গ্রাহকরাতো করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রভাবে আরো নাজুক অবস্থায় রয়েছেন। এ কারণে ব্যাংকগুলো দ্বিতীয় সারির গ্রাহকদের মাঝে ঋণ বিতরণ করে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। এসব কারণেও ঋণ বিতরণে কাক্সিক্ষত গতি আসছে না। তবে ছোট সবশ্রেণীর গ্রাহকদের এ কর্মসূচির আওতায় আনা গেলে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে বেশি অবদান রাখা যেত।

 


আরো সংবাদ



premium cement