২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে সৎ যোগ্যদের চান আইনবিদরা

-

সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সব আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এখন ৪০ লাখ ছাড়িয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক মামলার চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বিচার বিভাগ। বিচারক সঙ্কটে গত কয়েক বছরে আদালতে মামলার জট বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় সরকার সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে কিছু সংখ্যক বিচারক নিয়োগ দিতে যাচ্ছে এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টের গাইডলাইন অনুসরণ করে সৎ, যোগ্য, মেধাবী ও মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন ব্যক্তিদের উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ দেয়া হবে বলে প্রত্যাশা করেছেন আইনবিদরা। এ ছাড়া কারা উচ্চ আদালতের বিচারক হবেন সে বিষয়ে আইন চান আইনবিদরা। আর উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের বিষয়ে এক রায়ে সাত দফা গাইডলাইন বা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। এতে বলা হয়েছে, বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করার ক্ষেত্রে মেধাবী, প্রাতিষ্ঠানিক ও উচ্চতর পেশাগত যোগ্যতা সম্পন্ন, সৎ এবং আইনি জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। বিচারক হতে আগ্রহী প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দিতে হবে। এটা দেখার পর ইচ্ছা করলে প্রধান বিচারপতি সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করতে পারেন।
এ ব্যাপারে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, যাদের হাতে বিচারক নিয়োগ হয়, তারা জুডিশিয়ারিরই। তারা যেভাবে নিয়োগ করেন তার ওপর আস্থা থাকতে হবে। আমার প্রত্যাশা থাকবে সঠিক ব্যক্তি বা উপযুক্ত লোককে যেন বিচারক নিয়োগ করা হয়। নিয়োগে কোনো আইন বা নীতিমালা না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, বিচারক নিয়োগে নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, এত বছর পর্যন্ত বিচারক নিয়োগের কোনো আইন হয়নি। নিয়োগের বিধিমালা করার জন্য আমরা বারবার দাবি জানিয়েছি তাও করা হয়নি। তারপরও যেহেতু বিচারক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন, তাই আমি প্রত্যাশা করবÑ সৎ, যোগ্য ও মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট যে সাত দফা নির্দেশনা প্রদান করেছেন সেটা অনুসরণ করলেও হয়। আমি মনে করি উচ্চ আদালতের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসরণ করা হবে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী বলেন, অবশ্যই সৎ যোগ্য ও মেধাবীরা উচ্চ আদালতের বিচারক হবেন এমনটাই প্রত্যাশা করি। আমি মনেকরি বিচারক নিয়োগে দলীয় আনুগত্য বিবেচনা করা হয় না। মেধাবী ও সৎদের নিয়োগ করা হয়। আর দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়নি। তিনি আরো বলেন, বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানা উচিত। একই সাথে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আমার জানা মতে, কারা উচ্চ আদালতের বিচারক হবেন সে বিষয়ে কোনো আইন নেই। যা অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে হাইকোর্টের গাইডলাইনও আছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সৎ ও দক্ষতার বাইরে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এর কারণে বিচারের মান নিম্নমুখী হচ্ছে এবং মানুষ আদালতের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। উদাহারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, হাইকোর্টের তিনজন বিচারককে গত দুই বছর বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। তাদের বিচারকাজে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হচ্ছে না। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকার কারণে এটি করা হয়েছে। এজন্য আইনজীবীরা প্রত্যাশা করেন সৎ, মেধাবী ও দক্ষ বিচারক নিয়োগ করা হবে, দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নয়। আমার প্রত্যাশা নিয়োগের ক্ষেত্রে সৎ ও মেধাবীদের দেয়া হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মামলার জট কমাতে উচ্চ আদালতের হাইকোর্ট বিভাগে ১৩ থেকে ১৮ জন এবং আপিল বিভাগের জন্য হাইকোর্ট থেকে তিনজন বিচারপতি নিয়োগের তালিকা করা হয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও একজন সদস্য বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
বিচারক নিয়োগের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিচারক নিয়োগ ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত থাকবে। আশা করছি, শিগগিরই বিচারক নিয়োগ হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সদস্যের শূন্যপদও পূরণ করা হবে।
আপিল বিভাগে বর্তমানে পাঁচজন বিচারপতি বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। যেখানে আগে একই সাথে আপিলে দু’টি বেঞ্চে বিচারকাজ পরিচালিত হতো, বিচারকসংখ্যা কমে যাওয়ায় সেখানে এখন একটি বেঞ্চে বিচারকাজ চলছে। এর মধ্যে আগামী ৩০ ডিসেম্বর অবসরে যাবেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। ফলে আপিলে বিচারপতি সংখ্যা কমে হবে চারজন। বিষয়টি মাথায় রেখেই সরকার বেশ কয়েকজন বিচারককে আপিল বিভাগে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া চলতি বছরের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে বেশ কয়েকজন বিচারক অবসরে যাবেন। যার ফলে বিচারক সংখ্যা কমে আসবে। এতে মামলার জট আরো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকেই সরকার নতুন বিচারক নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবছে।
বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনসহ পাঁচজন বিচারপতি বিচারকাজ করছেন। আপিল বিভাগে একসময় সর্বোচ্চ ১১ জন বিচারপতিও দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্য দিকে হাইকোর্ট বিভাগেও বিচারক সঙ্কট রয়েছে। বর্তমানে এ বিভাগের মোট বিচারপতি ৯২ জন। এর মধ্যে ৫৩টি বেঞ্চে দায়িত্ব পালন করছেন ৮৮ জন বিচারপতি। বাকি পাঁচজনের মধ্যে দু’জন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কাজ করছেন। অসদাচরণের দায়ে বিচারিক দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয়েছে বাকি তিন বিচারপতিকে।
সংবিধানের ৯৪(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি সংখ্যা নির্ধারণ ও নিয়োগ দিয়ে থাকেন। সংবিধান অনুযায়ী ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পদে থাকা যায়।
এ দিকে সারা দেশে মামলার সংখ্যা বেড়ে এখন ৪০ লাখ ছাড়িয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক মামলার চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বিচার বিভাগ। ২০০৭ সালে মামলার এই সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার। প্রতি বছর পুরনো পরিসংখ্যানের সাথে গড়ে প্রায় ২ লাখ অনিষ্পন্ন মামলা নতুন করে যুক্ত হচ্ছে।
একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা ছিল ১৫ হাজার ২২৫টি। অর্থাৎ গড়ে বিচারপতিদের মাথাপিছু মামলা ৩ হাজার ৪৫টি। আর হাইকোর্ট বিভাগে মামলা রয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার ৯৬৩টি। হাইকোর্ট বিভাগের ৯২ জন বিচারপতির জন্য গড়ে মাথাপিছু মামলা রয়েছে ৪ হাজার ৯২৩টি।
নিয়োগে হাইকোর্টের সাত দফা নির্দেশনা : সংবিধানের ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, যেমনÑ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশী নাগরিক হতে হবে। ওই মূলনীতি ও চেতনায় বিশ্বাসী ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে বিচারক হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপারিশ করা যাবে না। বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করার ক্ষেত্রে মেধাবী, প্রাতিষ্ঠানিক ও উচ্চতর পেশাগত যোগ্যতাসম্পন্ন, সৎ ও আইনি জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে।
বিচারক হতে আগ্রহী প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দিতে হবে। এটা দেখার পর ইচ্ছা করলে প্রধান বিচারপতি সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগের জন্য সুপারিশ করতে পারেন।
বিচারক নিয়োগের সুপারিশের ক্ষেত্রে পেশাগত জীবনে একজন ব্যক্তির অর্জিত দক্ষতা ও পারদর্শিতাকে প্রথম বিবেচনায় নেয়া উচিত। ভারতের আইন কমিশনের ৮০তম প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী একজন বিচারকের পেশাগত পরিপক্বতা ও অভিজ্ঞতাকে তার বয়সসীমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। সেটা বিবেচনায় নিয়ে অভিমত হলোÑ সুপ্রিম কোর্টের বিচারক মনোনয়নের ক্ষেত্রে বয়সসীমা সর্বনিম্ন ৪৫ বছর হওয়া উচিত।
বিচারক হিসেবে নিয়োগে সুপারিশ করার ক্ষেত্রে আপিল বিভাগে নিবন্ধিত আইনজীবীদের মধ্য থেকে উচ্চ যোগ্যতা সম্পন্নদের অগ্রাধিকার দিতে পারবেন প্রধান বিচারপতি। তবে হাইকোর্ট বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে সততা ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে এমন নিবন্ধিত আইনজীবীকেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
জেলা ও দায়রা জজ আদালতে তিন বছরের কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নিম্ন আদালতের কোনো বিচারককে উচ্চ আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োগের জন্য বিবেচনা করা উচিত হবে না। অধস্তন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান যোগ্যতা হওয়া উচিত সততা। তবে মনে রাখা উচিত যে, উচ্চ মেধাসম্পন্ন ব্যক্তির যদি সততা না থাকে তবে তাকে কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া হলে সেটা হবে এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে আইনজীবী ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরীর করা রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে উল্লেখিত পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়।


আরো সংবাদ



premium cement