২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

খেলাপি ঋণ পরিশোধ করছেন না ব্যবসায়ীরা

আদায়ের হার মাত্র ১.৩৮ শতাংশ : বিপাকে ব্যাংক
-

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে এক দিকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, বিপরীতে কমে যাচ্ছে আদায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, তিন মাসে প্রায় ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায়ের হার মাত্র ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ করতে আয়ের বড় একটি অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
এ দিকে করোনার কারণে ব্যাংকগুলো প্রণোদনার প্যাকেজের আওতায় যে এক লাখ কোটি টাকার ওপরে ঋণ বিতরণ করেছে তার বড় একটি অংশ আদায় হচ্ছে না। বিশেষ করে বড় গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেছে। উল্টো এখন ব্যাংকের কাছে বাড়তি সময় চাচ্ছেন তারা। এতে উভয় সঙ্কটে পড়ে গেছেন ব্যাংকারোা।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, ঋণখেলাপিরা ঋণ আদায় না করায় ব্যবসায় অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছেন ভালো গ্রাহকরা। নিয়মিত যারা ঋণ পরিশোধ করছেন তাদের ব্যবসা ব্যয়, আর যারা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছেন না তাদের ব্যয় থেকে অনেক বেশি। কারণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সুদে-আসলে পরিশোধ করায় তুলনামূলকভাবে অপর ব্যবসায়ীর ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যায়। এ অসম প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষা পেতে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন ওই সব গ্রাহক ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। এভাবেই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ঋণ আদায় কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত জুন শেষে অবলোপনসহ মোট খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জুন শেষে আদায় হয়েছে মাত্র এক হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিয়মিত ৯৫ হ্জাার ২৪৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে তিন মাসে আদায় হয়েছে মাত্র এক হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা। আদায়ের হার মাত্র ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আর অবলোপন হওয়া খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৩ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র ১২৭ কোটি টাকা। আদায়ের হার মাত্র শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ। খেলাপি ঋণের আদায়ের এ বেহাল অবস্থা এর আগে কখনো হয়নি।
শুধু নিয়মিত খেলাপি ঋণই নয়, চলমান করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে গত বছর এক লাখ ৯ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ বড় গ্রাহকরা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হলেও ঋণ পরিশোধে তারা গড়িমসি করছেন।
ব্যাংকারোা জানিয়েছেন, তারা ছোট গ্রাহকদের যে ঋণ দিয়েছিলেন তার প্রায় পুরোটাই আদায় করতে পেরেছিলেন। সমস্যা দেখা দিয়েছে বড় গ্রাহকদের ক্ষেত্রে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এখনো শেষ হয়নি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমাতে সরকার এক টানা প্রায় দেড় মাস লকডাউন দিয়েছিল। এ সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য খুব একটি হয়নি। এ কারণে বড় গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। তারা এখন দুই বছরের সময় চাচ্ছেন। নীতিমালা অনুযায়ী এক বছরের বেশি সময় দেয়া যায় না। কিন্তু অনেকেই দুই বছর সময় চাচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে গ্রাহকদের সাথে আলাপ আলোচনা চলছে বলে ব্যাংকারোা জানান।
জানা গেছে, গত বছরজুড়েই এবং চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ মার্চ পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে শিথিলতা ছিল। করোনার কারণে ব্যবসা মন্দার কারণে সবশ্রেণীর ঋণের ক্ষেত্রে এ সুবিধা দেয়া হয়েছিল। কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাদেরকে খেলাপি করা যায়নি। এ সুযোগ পরবর্তীতে জুন মাস পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। এর পরেও অনেকে ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, বকেয়া কিস্তির ওপর ২০ শতাংশ এককালীন কেউ পরিশোধ করলে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ওই গ্রাহককে খেলাপি করা যাবে না। এ দিকে প্রণোদনার প্যাকেজের নীতিমালা অনুযায়ী চলতি মূলধন জোগান দেয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এ ঋণ এক বছরের জন্য গ্রাহক নিতে পারবেন। আবার এক বছরের মধ্যেই তাকে ফেরত দিতে হবে। এতে গ্রাহক যেমন সুদহারের ওপর ছাড় পাবেন, তেমনি ব্যাংক ছাড়ের অংশটুকু সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পাবেন। এক বছরের মধ্যে গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে আর এক বছর সময় বাড়িয়ে দিতে পারবে ব্যাংক। কিন্তু গ্রাহক সুদের হারের ওপর কোনো ভর্তুকি পাবেন না। এসব বাধ্যবাধকতার কারণে ব্যাংক এক বছরের বেশি সময় বাড়াতে পারছে না।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, খেলাপি ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংক বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। মোটা দাগে খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের আয় থেকে প্রভিশন ঘাটতি মেটাতে হচ্ছে। মন্দ ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ আয় খাতে নেয়া যায় না। এর ফলে ব্যাংকের সামগ্রিক আয় কমে যাচ্ছে। একই সাথে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। একই সাথে ঋণ আটকে যাওয়ায় এর বিপরীতে সংগৃহীত আমানত নির্ধারিত মেয়াদ শেষে নতুন আমানত নিয়ে পুরনো আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। যার সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।


আরো সংবাদ



premium cement