১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রেখে দিতে প্রস্তাব বিশ্বব্যাংকের

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রত্যাখ্যান
-

রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশে রেখে দিতে প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্ব ব্যাংক এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগকে জানিয়েছে। আর বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগ মতামত জানতে চেয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। বিশ্বব্যাংকের দেয়া প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশের সমাজে অন্তর্ভুক্তি নয়, বরং রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের পথ। জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপে থাকা বাংলাদেশের পক্ষে উদ্বাস্তুদের স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করা সম্ভব না। বিশ্বব্যাংকের এই প্রস্তাব এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিদ্যমান অবস্থানের পরিবর্তন কি না তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কাছে বিশ্বব্যাংক উদ্বাস্তু নীতি পর্যালোচনা রূপরেখাবিষয়ক একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এই উদ্বাস্তুনীতি রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য দেশে অবস্থিত সব শরণার্থীর জন্য প্রযোজ্য। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছিল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব মেনে নিয়ে সংস্থাটি থেকে ঋণ নিলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো কেবল কঠিনই হবে না, বরং তাদেরকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে রেখে দিতে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে মন্ত্রণালয়। তাই বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব মেনে না নিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মতে, বিশ্বব্যাংকের দেয়া প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হচ্ছে উদ্বাস্তু ও তাদের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করা, উদ্বাস্তুরা যে দেশে অবস্থান করছে, সেখানকার সমাজে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া অথবা তাদের ফেরত পাঠানো এবং নতুন উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেয়ার জন্য আশ্রয়দানকারী দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব মেনে নিলে রোহিঙ্গারা যেকোনো স্থানে চলাচল করতে পারবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বা ব্যবসা করতে পারবে। এ ছাড়া তাদেরকে নিবন্ধনের আওতায় এনে সামাজিক পরিচয়পত্রও দিতে হবে। এই কর্মকর্তা জানান, আগে জাতিসঙ্ঘ, বিশ্বব্যাংক ও পশ্চিমা দেশগুলো এ তিনটি উদ্দেশ্য আকারে-ইঙ্গিতে বা মুখে বলত। এই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা সরকারের কাছে প্রস্তাব আকারে তা উত্থাপন করেছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা দিন দিন কমছে। এতে তাদের জন্য মানবিক সহায়তার ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এ জন্য সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের জীবিকার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে, যাতে তারা নিজেদের উপার্জনে চলতে পারে।
সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধি ও অবাধ চলাচলের ওপর জোর দিচ্ছে। মিয়ানমারের কারিকুলামের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের শিক্ষা পদ্ধতি চালিয়ে যেতে চাইছে, যাতে প্রত্যাবাসনের পর তারা রাখাইন সমাজে সহজে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। একই সাথে কক্সবাজারের ওপর চাপ কমানোর জন্য ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় জাতিসঙ্ঘ যাতে সম্পৃক্ত হয়, সেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) নিয়ে জাতিসঙ্ঘের সাথে আলোচনা চলছে। আগামী মাসে এমওইউটি সই হতে পারে।
এ দিকে মিয়ানমারে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি স্তিমিত হয়ে গেছে। দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের আগে প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশ এই বৈঠক আয়োজনের তাগাদা দিলেও চীন বলছে, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে তা সম্ভব না। এ ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চেয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনলেও পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে না; বরং পর্দার অন্তরালে দেশটির সাথে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রত্যাবাসনই একমাত্র পথ : এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। তাদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণের জন্য যদি আমরা এসব মেনে নিই তবে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি যে লক্ষ্যগুলো আছে সেগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে। এ জন্য আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে।’ উদ্বাস্তু সমস্যা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, এটি তিনভাবে সমাধান করা যায়। একটি আছে অন্তর্ভুক্তিকরণ, আরেকটি হচ্ছে তৃতীয় দেশে সেটেলমেন্ট এবং অপরটি হচ্ছে প্রত্যাবাসন। তিনি বলেন, আমাদের জন্য তৃতীয় দেশে সেটেলমেন্ট ফিজিবল না। কারণ সংখ্যাটি অনেক বড়। যদি সংখ্যা ৩০ বা ৪০ হাজার হতো তাহলে বিভিন্ন দেশে ভাগ করে দেয়া যেত। কিন্তু সংখ্যাটি ১০ লাখের ওপরে। এখন পৃথিবীর কোনো দেশ এই পরিমাণ মানুষ নেবে না, এটাই বাস্তবতা।
আরেকটি সমাধান হচ্ছে অন্তর্ভুক্তীকরণ, কিন্তু বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ এবং এখানে প্রচুর শ্রমিক আছে। ফলে বাড়তি শ্রমিকের কোনো প্রয়োজন নেই এবং সে সম্ভাবনাও নেই বলে তিনি জানান। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘সুতরাং আমাদের জন্য একমাত্র অপশন হচ্ছে তাদের নিজ ভূমিতে টেকসই ও সম্মানের সাথে প্রত্যাবাসন।’
অন্তর্ভুক্তীকরণের বিষয়ে জাতিসঙ্ঘ বা বিশ্বব্যাংক চিন্তা করতে পারে কিন্তু আমরা এটি করতে পারব না এবং এটি তাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘গতবারই তারা আমাদের যখন এ ধরনের ভাষা বা পয়েন্ট বলেছিল তখন তাদের আমরা বলেছি যে এটি আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়।’ পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘আমাদের নজরে যেটি আসছে সেটি আমরা পয়েন্ট-আউট করছি এবং সংশ্লিষ্ট যারা রয়েছে তাদের বলছি যে এ ধরনের শর্ত মানা আমাদের পক্ষে সম্ভব না।’
রোহিঙ্গাদের শিক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যদি দিতে হয় তাহলে মিয়ানমারের কারিকুলাম অনুযায়ী দিতে হবে। কারণ আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এই লোকগুলোর মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া। কিন্তু এমন কোনো ধরনের শিক্ষা যেখানে আমাদের এখানে অন্তর্ভুক্তি হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে, এ ধরনের শিক্ষা আমরা দিতে চাই না।’

 


আরো সংবাদ



premium cement