পাচারে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে নতুন রুট

উন্নত জীবনের আশায় বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য প্রতিবছর কয়েক লাখ মানুষ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। যাদের বড় একটি অংশ মানবপাচারের শিকার হচ্ছেন। প্রচলিত শ্রমবাজারগুলোতে অধিক খরচে ভিটেমাটি বিক্রি করে প্রবাসী জীবন বেছে নিচ্ছেন এবং তাদের মধ্যে একটা অংশ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। অন্য দিকে, অবৈধপথে বিভিন্ন রুটে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়া বা পাঠানোর ঘটনাও বাড়ছে। আগে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়াসহ বেশ কিছু দেশে মানবপাচারের ঘটনা ছিল। এখন নতুন রুট যুক্ত হচ্ছে, ধরনও বদলাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় গ্রেফতার অভিযান চালালেও থেমে নেই মানবপাচার চক্র। তারা প্রতিনিয়ত নানা কায়দায় যুবক শ্রেণীর বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রত্যাশীর উচ্চাকাক্সক্ষাকে জাগ্রত করে বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে বিদেশে পাচার করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, করোনা মহামারীর মধ্যেও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করছে যে দেশগুলোর মানুষ, বাংলাদেশ এখন সেই তালিকায় সবার শীর্ষে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত তিন হাজার ৩৩২ জন বাংলাদেশী এভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। আর গত একযুগে অনিয়মিতভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন অন্তত ৬০ হাজার মানুষ। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য বলছে, এভাবে যারা ইউরোপে যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছর। অবশ্য শুধু ইউরোপ নয়, করোনা মহামারীর মধ্যেও শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার কিংবা ভারতে নারী-কিশোরী পাচার কোনোটাই থেমে নেই। বরং এসব ক্ষেত্রে এখন সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম ব্যবহার করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেই আজ শুক্রবার পালিত হবে আন্তর্জাতিক মানবপাচারবিরোধী দিবস। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে ৩০ জুলাই দিনটিকে মানবপাচারবিরোধী দিবস করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ভুক্তভোগীদের কণ্ঠস্বর পথ দেখায়।’ দিবসটি পালন উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার ব্র্যাক মাইগ্রেশন ‘মানবপাচার ও অনিয়মিত অভিবাসন: পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানের (জুম) আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারথম্যান সাবেক সচিব নাছিমা বেগম বলেন, মানবপাচার মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এটি একটি জঘন্যতম অপরাধ। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ বিষয়ে সজাগ। দায়িত্বরত সবাইকে এ বিষয়ে আরো সতর্ক হতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে কিশোরী পাচারের ঘটনা উল্লেখ করে নাছিমা বেগম বলেন, কী করে তারা ভারতীয় (আধার কার্ড) নানা ধরনের পরিচয় কার্ড পেয়ে যাচ্ছে? ভ্রমণ ভিসায় কী করে এতো লোক চলে যাচ্ছে সেটি দেখতে হবে। এত এত পাচারকারী কিন্তু মানবপাচার আইনে ৯ বছরে ৩৬টা মামলায় মাত্র ৭১ জনের সাজা হলো কেন? অপরাধীদের বিচার করতে হবে। মামলার বিচার বাড়াতে হবে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো: শহীদুল আলম বলেন, জেনে বুঝে দক্ষ হয়ে বিদেশে যেতে হবে। প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। একইভাবে যারা দায়িত্ব পালন করেন সেই সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ সবার মানবপাচার ও অভিবাসন আইনের বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ দরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জি এস এম জাফরউল্লাহ পাচাররোধে সরকারের নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা সবাই মিলে একসাথে কাজ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন আরো তৎপর হয় সে ব্যাপারে আমরা নজর রাখবো।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মানবপাচার বিষয়ক সেলের বিশেষ পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান বলেন, দেশের ভেতরকার পাচারের মামলাগুলো তদন্ত করা সহজ, কারণ সব তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু বিদেশে পাচারের ঘটনায় অধিকাংশ সময় ভুক্তভোগীরা যথেষ্ট তথ্য দিতে চান না।
ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কেএএম মোর্শেদ বলেন, কোভিড পরবর্তী সময়ে মানবপাচারের ঝুঁকি বেড়েছে। আমরা চাই লোকজন বিদেশে যাবে। কিন্তু বৈধভাবে। সবার সম্মিলিত উদ্যোগেই সেটি সম্ভব। অনুষ্ঠানে মানবপাচার ও অনিয়মিত অভিবাসনবিষয়ক পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে মাইগ্রেশন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, বাংলাদেশ আজ সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার দিক থেকে প্রথম এটি আমাদের জন্য লজ্জার।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন সূত্রে জানা যায়, গত ২১ জুন সাগরপথে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে ১৭ বাংলাদেশী প্রাণ হারান। তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড ভূমধ্যসাগর থেকে বাংলাদেশীসহ ৩৮০ জনকে জীবিত উদ্ধার করে। এর আগে গত ২৪ জুন ২৬৭ জনকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড যার মধ্যে ২৬৪ জনই বাংলাদেশী। এর আগে ১০ জুন ১৬৪ বাংলাদেশীকে তিউনিসিয়া উপকূল থেকে উদ্ধার করে দেশটির কোস্টগার্ড। এর আগে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় গত ১৮ মে ৩৬ জন, ২৭ ও ২৮ মে ২৪৩ বাংলাদেশীকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। এ বছর এভাবে মোট তিন হাজার ৩৩২ জন বাংলাদেশীকে উদ্ধার বা আটক করা হয়েছে।
ইউএনএইচসিআরের তথ্যনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের ২২ লাখ ২৪ হাজার ২৪৫ জন মানুষ এভাবে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যায়। আর একই সময়ে এভাবে যেতে গিয়ে ২১ হাজার ৭০৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের তথ্য অনুযায়ী, যত লোক এভাবে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন তার সাড়ে ১৪ শতাংশই বাংলাদেশী, অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী। ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ থেকে এভাবে ৬০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশী ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মানবপাচারের যেসব মামলা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, প্রায় দুই হাজার নারী মানবপাচারের শিকার হয়েছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী শুধু ২০২০ সালে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকালে উদ্ধারকৃত নারীর সংখ্যা ৩০৩ জন।
ইউএনএইচসিআরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে এক হাজার ৫৯৭ জন রোহিঙ্গা পাচার হয়। ২০২০ সালে অন্তত দুই হাজার ৪০০ মানুষ সাগরপথে পাড়ি দিয়েছে। এভাবে যেতে গিয়ে অন্তত ২০০ লোক ডুবে গেছে। আগে পুরুষরা এভাবে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার পথে গেলেও এখন যারা যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগই নারী ও কিশোরী।
মামলা হলেও বিচারে দীর্ঘসূত্রতা : মানবপাচার প্রতিরোধে সরকার ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন করে। এই আইনে ২০১২ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ৫ হাজার ৭৩৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় দেখা গেছে, ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ পাচারের শিকার। এতে মোট আসামির সংখ্যা সাড়ে ২৪ হাজারেরও বেশি। কিন্তু ৫ হাজার ৭৩৮টি মামলার মধ্যে গত ৯ বছরে মাত্র ২৮২টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩৬টি মামলায় মাত্র ৭১ জনের সাজা হয়েছে। বাকিরা অব্যাহতি পেয়ে গেছে। বাকি প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মামলা এখনো চলমান। অর্থাৎ মামলা নিষ্পত্তির হার ৪ শতাংশ। আর সাজা হয়েছে ১ শতাংশেরও কম (দশমিক ৬২ শতাংশ)। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সঠিক সময়ের মধ্যে বিচারকাজ শেষ না হওয়ায় ও পাচারকারীদের শাস্তি না হওয়ার কারণে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। আর অসহায় হয়ে পড়েছেন পাচারের শিকার লোকজন।