২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভরা মৌসুমেও চালের উচ্চমূল্য

সংগ্রহে ধীরগতি
-

দেশে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে এবার। গত বছরের তুলনায় এবার উৎপাদন বেড়েছে ১২ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি। কিন্তু ভরা মৌসুমেও দেশে চালের বাজার লাগামহীন। মোটা ও চিকন, সব ধরনের চালের দামই ঊর্ধ্বমুখী। কেন এই ঊর্ধ্বমুখী? জবাব নেই সংশ্লিষ্টদের। খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, বোরো ফসল ভালো হওয়ার পরও চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ দেখছি না। চালের দাম যেন কোনো সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজিতে না বাড়ে সে দিকটি দেখা হচ্ছে। এতে যদি কৃষকরা লাভবান হয় সেটাও দেখতে হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয় পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বলে জানান তিনি।
রংপুরে নবদীগঞ্জে হিমাগার মালিক সমিতির নেতাদের সাথে গতকাল বৃহস্পতিবার মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত বছর বোরো ধানের চাল উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ৯৬ লাখ মেট্রিক টন; এবার হয়েছে দুই কোটি ৮ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এবার ১২ লাখ টনেরও বেশি উৎপাদন হয়েছে। এ বছরের বোরোতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই কোটি ৫ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিন লাখ টনের বেশি উৎপাদন হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: আসাদুল্লাহ নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, হাইব্রিড ও উন্নতজাতের ধান বেশি চাষ, অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এবার বোরোতে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ফলন হয়েছে।
রাজধানীতে সরু চাল (নাজির ও মিনিকেট) প্রতি কেজি ৬০-৬৫ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৩-৫৮ টাকা। একইভাবে মোটা চাল (২৮) বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকায়। চালের এই উচ্চমূল্যে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ চিঁড়েচেপ্টা। চালের দাম তাদের নাগালের বাইরে থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষজন পরিবার পরিজন নিয়ে নিদারুণ কষ্টে আছেন। সাধারণ মানুষ তো বটেই চালের ঊর্ধ্বমুখী মূল্য নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলেও। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে যে পরিমাণ চালের প্রয়োজন হয় তার প্রায় ৫৬ শতাংশই আসে এই বোরো মৌসুমে। অথচ বোরোর এই ভরা মৌসুমেও নিয়ন্ত্রণহীন চালের বাজার।
গত ২৮ এপ্রিল থেকে ধান এবং ৭ মে থেকে চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এবার সাড়ে ৬ লাখ টন ধান এবং সাড়ে ১১ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। গত ১৩ জুন পর্যন্ত এক লাখ ৯৭ হাজার ৭৭১ মেট্রিক টন বোরো ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। আর চাল সংগ্রহ করা হয়েছে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৬৮১ মেট্রিক টন। কেজিপ্রতি ২৭ টাকা দরে ধান এবং ৪০ টাকা দামে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৮ টাকা দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল কেনার ঘোষণা রয়েছে সরকারের। খাদ্য মন্ত্রণালয় চালকল মালিকদের কাছ থেকে এই ধান ও চাল সংগ্রহ করছে। দেশে এই মুহূর্তে (১৬ জুন পর্যন্ত) চাল মজুদ রয়েছে ৯ লাখ ৩৯ হাজার মেট্রিক টন। ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চলবে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। তবে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার চলতি জুন মাসের মধ্যে বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৭৫ শতাংশ অর্জন করার তাগাদা দিয়েছেন খাদ্য কর্মকর্তাদের। তিনি বলেন, অগ্রগতি সন্তোষজনক না হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সাথে ফড়িয়াদের কাছ থেকে সরকার ধান সংগ্রহ করবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন তিনি।
সবেমাত্র বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে। ধান-চাল সংগ্রহের মধ্যেই চালের বাজারে এই নৈরাজ্য নিয়ে ক্ষুব্ধ মানুষ। বিগত কয়েক বছর ধরে নানা অজুহাতে মিলাররা চালের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। কখনো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া আবার কখনো সরবরাহে ঘাটতি বলে মিলাররা চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর তেমন ব্যবস্থা নেই সরকারের। কারসাজি করে মিলারদের চালের দাম বাড়ানোর কথা খোদ খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও বিভিন্ন সময় বলেছেন। এছাড়া চালের দাম কমাতে খাদ্যমন্ত্রী দফায় দফায় মিলারদের সাথে বৈঠকও করেছেন। কিন্তু, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মহামারীর মধ্যে আগের কয়েকটি ধানের মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী না হওয়ায় দেশে খাদ্যশস্যের মজুদ কমে যায়। সরবরাহ সঙ্কটে চালের বাজারও চড়া হয়ে যায়। মূলত মিল মালিকরা সরকারকে চাল সরবরাহ না করায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যায়নি। তারা চালের দর বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে ও মজুদ ঠিক রাখতে শেষ পর্যন্ত সরকারকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
গত ১৪ জুন সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বোরো সংগ্রহে ব্যর্থতায় কোনো অজুহাত চলবে না উল্লেখ এই সময়ে কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন খাদ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মিলাররা কেন চাল সরবারহে গড়িমসি করছেন, তা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের খতিয়ে দেখতে হবে। মাঠ পর্যায়ের তথ্য সঠিক হলে পরিকল্পনা করা সহজ হয়।’ চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিনি জেলা প্রশাসকের সাথে সমন্বয় করে বাজার ও মিলগেট মনিটরিং কাজে খাদ্য কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর নির্দেশ দেন। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘মনে রাখতে হবে খাদ্য অধিদফতর ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে। যে কোনো দুর্যোগে এই সংগ্রহ করা খাদ্যশস্যই মুখ্য ভূমিকা রাখে।’
চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে চালকল মালিকরা বলছেন, বাজারে চালের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ ধানের দাম বৃদ্ধি। কৃষকরা ধান ঘরে মজুদ করে বেশি আয়ের আশায় হাটবাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। সে কারণে চাহিদার তুলনায় বাজারে ধানের সরবরাহ কম থাকায় ব্যবসায়ীরা বেশি দামে ধান কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে চালের দাম বেড়েছে। অথচ গ্রাম পর্যায়ে চিত্র ভিন্ন। বিভিন্ন হাটবাজারে সাধারণ কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য সেভাবে পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ আসছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, দাম কমাতে বাজার তদারকি সংস্থাগুলোকে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করা দরকার। এছাড়া কৃষক পর্যায় থেকে সরাসরি চাল নিয়ে সরকারি মজুদ বাড়াতে হবে। আমদানি করে চালের সরবরাহ বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে অসাধু যারা রয়েছে তারা সুযোগ পাবে না। পাশাপাশি কঠোর তদারকির মাধ্যমে দাম ভোক্তা সহনীয় করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল