২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
পরীমণি ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা

মাদক মামলায় নাসির অমি ৭ দিনের রিমান্ডে

পুলিশ ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে : পরীমণি
-

ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে চিত্রনায়িকা পরীমণির দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতা নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমিকে মাদক মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এই আদেশ দেন। এ ছাড়া তিন নারীর তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
গ্রেফতারকৃত পাঁচজনকে গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাদের দশ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম নিভানা খায়ের জেসি আসামি নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমির সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ ছাড়া আদালত মামলার অন্য তিন আসামি লিপি আক্তার, সুমি আক্তার ও নাজমা আমিন স্নিগ্ধাকে (২৪) তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে পুলিশ নাসির উদ্দিন মাহমুদসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় মামলা দায়ের করে। এই মামলায় লিপি আক্তার, সুমি আক্তার ও নাজমা আমিন স্নিগ্ধাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। গত সোমবার বিকেলে তাদের রাজধানীর উত্তরা থেকে ১ হাজার ইয়াবা, বিদেশী মদসহ গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। আসামিদের গ্রেফতারে নেতৃত্ব দেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মশিউর রহমান।
চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমণি ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ব্যবসায়ী ও জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসির উদ্দিন মাহমুদ, অমিসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে গত সোমবার সাভার থানায় মামলা দায়ের করেন।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ৮ জুলাইয়ের মধ্যে দেয়ার নির্দেশ : পরীমণির দায়ের করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আগামী ৮ জুলাইয়ের মধ্যে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট (সিএমএম) আদালত এই আদেশ দেন।
ঢাকা জেলা পুলিশের পরিদর্শক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন আদালত। গত ৯ জুন রাতে ঢাকা বোট ক্লাবে ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ পরীমণির। রোববার রাতে প্রথমে তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরেন এই অভিনেত্রী। পরে নিজ বাসায় সাংবাদিকদের সামনে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন।
ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে পরীমণি সোমবার ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে সাভার থানায় মামলা করেন। এরপরে প্রধান আসামি নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও অমিসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের কাছ থেকে মদ ও ইয়াবা জব্দ করা হয়।
পুলিশ ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে : পরীমণি গতকাল বিকেল ৪টার দিকে হঠাৎ করেই গোয়েন্দা কার্যালয়ে হাজির হন। এ সময় তার সাথে ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক, লেখিকা চয়নিকা চৌধুরী। গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদের কার্যালয়ে তারা প্রবেশ করেন। সেখানে নিজের ওপর সেদিন রাতে নির্যাতন এবং এ বিষয়ে দায়ের করা মামলা সম্পর্কে কথা বলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তার সাথে। এ সময় গোয়েন্দা কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করছিলেন, শিল্পী সমিতির নেতা ও সংবাদকর্মীরা। এ ছাড়া উৎসুক লোকজনও ভিড় জমান।
গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন পরীমণি। এ সময় গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদও উপস্থিত ছিলেন। আলাপকালে পরীমণি বলেন, আমাকে ডিবি পুলিশ ডাকেনি, আমি নিজে থেকেই এখানে এসেছি। আমাকে কাজে ফিরতে হবে। পুলিশ বন্ধুসুলভ আচরণ করেছে। হারুন স্যার অনেকটা ম্যাজিকের মতো সবকিছু করেছেন। এতটা তাড়াতাড়ি ম্যাজিকের মতো পুলিশ আমাকে সহযোগিতা করবে সেটা আমি ভাবতে পারিনি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেখলাম অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আমার বিশ্বাস সঠিক বিচার পাব।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রথম দিনের বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরীমণি বলেন, প্রথমে অভিযোগটা আপনারা আমার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজের মাধ্যমে জেনেছিলেন। এরপর আমি অনেক কথাই বলেছি। এ বিষয়ে ফেসবুক পেজে ব্যাখ্যাও করেছি।
মদ খেতে যাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি মদ খেতে বা ছিনতাই করতে গিয়েছিলাম, এমন অভিযোগ কি বিশ্বাসযোগ্য? আপনারা কি তাই মনে করেন? আমি কতটা মানসিকভাবে বিপর্যন্ত হয়েছিলাম সেটা কেবল আমিই জানি। সবাই আমাকে সাপোর্ট করেছে। সবার ভালোবাসা দেখে আমি অভিভূত। আমি এখন উঠে দাঁড়াতে পারছি।
আইজিপির সাথে যোগাযোগ ও অসহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি আইজিপির কাছে বক্তব্য পৌঁছাতে পারিনি বলেই এত কথা। তিনি আমার একমাত্র ভরসাস্থল ছিলেন। তার কান পর্যন্ত আমার বার্তা পৌঁছার সাথে সাথেই তিনি দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছেন।
শিল্পী সমিতি সম্পর্কে নিজের হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমি বলেছিলাম, শিল্পী সমিতির হয়ে আমি আইজিপি বেনজীর স্যারের সাথে একটু বসতে চাই, কথা বলতে চাই। তুমি (জায়েদ) একটু সহযোগিতা করো। তার জবাবে জায়েদ বলেছিলেন, সরাসরি তুমি এলে বেনজীর স্যারের সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিতে পারব।
সেই রাতে আপনি মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পরীমণি বলেন, আমাকে মুখ চেপে জোর করে মদ খাওয়ানো হয়েছিল। জানি না ওই অবস্থায় আমাকে মদের সাথে আর কী কী খাওয়ানো হয়েছিল? ওই সময় আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি মরে যাচ্ছিলাম। আমি যে মরে যাচ্ছিলাম সেই অবস্থা জানাতেই থানা পুলিশে গিয়েছিলাম। পুরোটাই থানা পুলিশকে জানিয়েছি এবং তাদের বলেছি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। আমাকে মদ খাওয়ানো হয়েছিল, আমি ঠিক নেই, আমি সুস্থ নই, আমি এখনো সুস্থ না। আমার সমস্যা হচ্ছে। আমি কখনোই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলিনি। তারা আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে।
এ সময় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার হারুন অর-রশিদ বলেন, ঢাকা বোট ক্লাবে ঘটনার পর পরীমণি পুলিশ ও আইজিপি স্যারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন ঠিকই কিন্তু প্রযোজক সমিতি ও শিল্পী সমিতি সেই সুযোগটা করে দেয়নি। এটিই পরীমণির অভিযোগ ছিল। তিনি বলেন, পরীমণি পুলিশকে ধন্যবাদ দিতে ডিবি কার্যালয়ে এসেছিলেন।
হারুন অর-রশিদ বলেন, মামলা রেকর্ড হওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পরীমণি বলেছেন, পুলিশ ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে এবং এটাও বলেছেন যে, তিনি আইজিপির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং চলচ্চিত্র শিল্পীদের কাছে আবেদনও করেছিলেন কিন্তু তার (আইজিপি) কাছে যেতে পারেনি। এরপরও আইজিপি স্যার ঘটনাটি জানার সাথে সাথে আমাদের জানিয়েছেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে আসামিদের গ্রেফতার করি।
বনানী থানায় পরীমণির অভিযোগের বিষয়ে ডিবি কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার রাতে ৪টায় বনানী থানায় পরীমণি গিয়েছিলেন কিন্তু ওই সময় ওসি সাহেব থানায় ছিলেন না। থানায় অসুস্থতাবোধের কারণ হলোÑ সাময়িকভাবে পরীমণি বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। ওই সময় পরীমণি দ্রুত থানা পুলিশের সহায়তায় হাসপাতালে চলে যান।
আসামিদের গ্রেফতারের পর পুলিশকে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য পরীমণি তার বাসা থেকে ডিবি অফিসে ছুটে এসেছেন। পরীমণি এসে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং মামলার যাবতীয় বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। পরীমণি পুলিশের কাছে অনুরোধ করেছেন, মামলাটি যেন সুষ্ঠুভাবে তদন্ত হয়। যত বড় অফিসারই হোক আমরা কাউকে ছাড় দেবো না।
তিনি বলেন, পুলিশ সবসময় চলচ্চিত্র সমিতি এবং যারা চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত আছেন সবাইকে নিয়ে একসাথে কাজ করে। তাদের যেকোনো সমস্যায় পুলিশ এগিয়ে যাবে। আমরা মামলাটি শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে দেখভাল করব, যাতে সুষ্ঠু বিচার হয়। এ মামলায় যদি আরো আসামি থাকে তাহলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।
এত রাতে পরীমণি সেখানে না গেলেও পারতেন : চিত্রনায়িকা পরীমণি এত রাতে বোট ক্লাবে না গেলে তার সাথে খারাপ ঘটনাটি ঘটত না বলে মনে করেন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর। তিনি বলেন, এত রাতে পরীমণি সেখানে না গেলেও পারতেন। গতকাল ডিবি অফিসের সামনে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন। পরীমণি এত রাতে ক্লাবে গিয়েছিলেন কেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মিশা বলেন, দেখুন, ১৮ বছরের পর সন্তানের ওপর পিতার কোনো কর্তৃত্ব থাকে না। রাতে সিভিলিয়ান ক্লাবে গেলে দোষ না হলে পরীমণি গেলে দোষ হবে কেন? ক্লাব খোলা আছে কেন? তাহলে ক্লাব কালচারটা উঠিয়ে দেন। ক্লাব খোলা থাকলে ৮ থেকে ১০ জন সিভিলিয়ান যায়, তাহলে একজন আর্টিস্ট গেলে সমস্যাটা কী? আমি নিরপেক্ষভাবে বলব যে, পরীমণি যে অবস্থানের নায়িকা, সেখান থেকে যদি ছবির সাইনিংয়ের ব্যাপার হয় তাহলে বাসায় হলে ভালো হতো।
আসামি নাসির উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, পরীমণি মিথ্যা বলেছেন। পরী মদ্যপ অবস্থায় ক্লাবে গিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে মিশার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি কী বলেছেন সে বিষয়ে আমি তো কিছু বলতে পারব না। দেশে বিচারব্যবস্থা আছে, এটা দেখার লোক আছে। পরীমণি কী অবস্থায় ছিল, যে ক্লাবে গিয়েছিল সেখানের সিসিটিভি ফুটেজ থাকার কথা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে, তিনি বললে তো হবে না। তারা পরীকেও জিজ্ঞেস করবে। যেটা সত্য সেটাই বেরিয়ে আসুক। মিথ্যা কোনো কিছু না আসুক। আমার ছেলেও যদি অন্যায় করে আমি কী তার পক্ষে যাব নাকি? বিষয়টি চুলচেরা বিশ্লেষণ হোক।
তিনি আরো বলেন, আমি বাংলাদেশে বাস করি। দেশের একটা কালচার আছে, সেই কালচারকে আমি সম্মান করব। দেশে সব ধর্মের মানুষের মধ্যে যথেষ্ট সমন্বয় আছে। সেই সন্বয়কে সম্মান করব। দেশকে সুস্থভাবে পরিচালনা করার প্রতিনিধি আমরা, আমরা উগ্রতা থেকে দূরে থাকি এটা আমার মূল কথা।


আরো সংবাদ



premium cement