২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ইসরাইলে নেতানিয়াহু যুগের অবসান

বেনেতের নেতৃত্বে নতুন সরকার
-

ইসরাইলে দীর্ঘ দিনের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর যুগের অবসান ঘটিয়ে জোট সরকার গঠন করেছে রক্ষণশীল নাফতালি বেনেত ও মধ্যপন্থী ইয়ায়ির লাপিদের জোট সরকার। গতকাল রোববার স্থানীয় সময় বিকেল ৪টায় শুরু হওয়া দেশটির পার্লামেন্ট নেসেটের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে মধ্যপন্থী ইয়ায়ির লাপিদ ও রক্ষণশীল নাফতালি বেনেতের নতুন জোট সরকারের পক্ষে আস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়। বিবিসি, আলজাজিরা ও জেরুসালেম পোস্ট।
লাপিদ ও বেনেতের এই জোটে রক্ষণশীল, মধ্যপন্থী ও উদার, সব ধারার রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। এ ছাড়া ইসরাইলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংখ্যালঘু আরব ফিলিস্তিনি নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব থাকছে জোট সরকারে। নেসেটের সদস্যদের আস্থা ভোটে জোট সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় দেশটির দীর্ঘ দিনের প্রধানমন্ত্রী রক্ষণশীল লিকুদ দলের প্রধান বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর শাসনের অবসান হলো। ২০০৯ থেকে টানা ১২ বছরসহ মোট ১৫ বছর তিনি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাকে ক্ষমতাচু্যুত করতে লাপিদ-বেনেতের জোট সরকার গঠনের বিরোধিতা করে এসেছেন। জোট গঠনের মাধ্যমে নেতানিয়াহু পরবর্তী সরকার গঠনের এই চেষ্টাকে নির্বাচনী জালিয়াতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে জোটে থাকা সাবেক মিত্রদের প্রধানমন্ত্রিত্বসহ বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। তবে ইসরাইলে সরকার পরিবর্তনের এই সম্ভাবনায় কোনো উৎসাহ নেই ফিলিস্তিনিদের। তাদের মতে, নতুন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেত ইসরাইলে নেতানিয়াহুর রক্ষণশীল নীতিই অব্যাহত রাখবেন।
ইসরাইলে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় গত ২৩ মার্চ দুই বছরের মধ্যে চতুর্থ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই নির্বাচনেও কোনো দল বা জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। দেশটিতে সরকার গঠনের জন্য ১২০ আসনবিশিষ্ট আইন পরিষদ নেসেটের ৬১ সদস্যের সমর্থনের প্রয়োজন হয়।
প্রথম দফা আলোচনার পর নেসেটের ৫২ সদস্য প্রধানমন্ত্রী পদে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সুপারিশ করায় এপ্রিলের শুরুতে তাকে সরকার গঠনের জন্য প্রথম মনোনয়ন দেন ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট রিওভেন রিভলিন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত না হলেও ওই সময় এটিই ছিল সর্বোচ্চ মনোনয়ন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে নেতানিয়াহুকে সমর্থন করা জিউনিস্ট পার্টি কোনো আরব দলের সাথে সরকার গঠনের অস্বীকৃতি জানানোয় তিনি সরকার গঠনে ব্যর্থ হন। নেতানিয়াহুর ব্যর্থতার পর ৫ মে নতুন করে নেসেট সদস্যদের সাথে আলোচনা করেন প্রেসিডেন্ট রিভলিন। নতুন আলোচনায় রক্ষণশীল ইয়ামিনা পার্টির প্রধান নাফতালি বেনেতের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির এক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে মোট ৫৬ সদস্যের সুপারিশ পান ইয়েশ আতিদ দলের প্রধান ইয়ায়ির লাপিদ।
২ জুন সরকার গঠনে নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হওয়ার সামান্য আগে ইয়ায়ির লাপিদ সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। নাফতালি বেনেতের ইয়ামিনা দল ও অন্য আরো ছয়টি দলের সাথে দীর্ঘ আলোচনা শেষে সমঝোতার পর তিনি সরকার গঠনের এই ঘোষণা দেন। সমঝোতা অনুসারে ইসরাইলের নতুন সরকারের চার বছরের মেয়াদের প্রথম দফায় দুই বছর বেনেত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। পরে শেষ দুই বছরের জন্য ইয়ায়ির লাপিদ তার কাছ থেকে সরকারের নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
নতুন প্রধানমন্ত্রী সাবেক কমান্ডো, নিজের চেষ্টায় প্রযুক্তি খাতের সফল ব্যবসায়ীতে পরিণত হওয়া কট্টর জাতীয়তাবাদী নেতা নাফতালি বেনেত একজন অর্থডক্স ইহুদি। রোববার নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা এক ছবিতে বেনেতকে প্রার্থনা করতে দেখা যায়। বেনেতের কট্টরপন্থী দল ইয়ামিনা সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনে জিতেছে মাত্র ছয়টি আসনে। কিন্তু অল্প ওই আসনই পরে হয়ে উঠেছে তার তুরুপের তাস। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে বেনেতের দলের আবস্থান যৌথভাবে পঞ্চম, কিন্তু তিনিই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছেন ‘কিংমেকার’। কারণ সরকার গড়তে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রধান দু’টি পক্ষের কাছে পর্যাপ্ত আসন নেই। উভয় দল থেকে তাই বেনেতকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। বেনেত শেষ পর্যন্ত লাপিদের প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
জোট সরকারে ডানপন্থী, মধ্যপন্থী এবং বামপন্থী সব মতাদর্শের দলই রয়েছে। ইয়ায়ির লাপিদের ইয়েশ আতিদ ও নাফতালি বেনেতের ইয়ামিনা দল ছাড়াও প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্টজের মধ্যপন্থী ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট, অ্যাভিগদর লিবারমানের রক্ষণশীল ইসরাইল বেইতেইনু, মিরেভ মিশেইলির নেতৃত্বের মধ্য-বামপন্থী লেবার পার্টি, গিদন সারের নেতৃত্বের মধ্য-ডানপন্থী নিউ হোপ পার্টি, নিৎজান হরোউৎজের বামপন্থী মেরেৎজ এমনকি ইসরাইলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংখ্যালঘু আরব দলগুলো থেকে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছে। মানসুর আব্বাসের নেতৃত্বের আরব-ইসরাইলিদের রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড আরব লিস্ট এই জোটে রয়েছে। ইসরাইলে মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ আরব। বৈচিত্র্যে ভরা লাপিদের এই জোট কত দিন ঐক্য ধরে রাখতে পারবে তা নিয়ে তাই অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
নতুন সরকার ফিলিস্তিনের মতো সংবেদনশীল আন্তর্জাতিক বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন এড়িয়ে যেতে বড় ধরনের পরিকল্পনা করেছে। তারা আন্তর্জাতিক বিষয়ের পরিবর্তে দেশের উন্নয়নে বেশি মনোযোগ দিতে চায়। ফিলিস্তিন নেতারাও অবশ্য নতুন সরকার নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নন। বরং তারা বলেছেন, নেতানিয়াহু ও বেনেতের মধ্যে তারা কোনো পার্থক্য দেখতে পাচ্ছেন না। বেনেত নিজেও উগ্র ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা প্রত্যাখ্যান করে আসা এই নেতা এ বিষয়ে নিজেকে নেতানিয়াহুর চাইতেও ‘কট্টর’ হিসেবে দাবি করে থাকেন। ইসরাইলের বড় শত্রু ইরানের বিষয়েও বেনেতের অবস্থান নেতানিয়াহুর মতোই থাকবে। বেনেতের এক মুখপাত্র বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরান পরমাণু চুক্তিতে ফেরত যায় তবে তিনি ‘তীব্র আপত্তি’ জানাবেন। তবে বেনেত যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন প্রশাসনের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখতে চান।

 


আরো সংবাদ



premium cement