২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনায় বিপর্যয় ঈদ অর্থনীতিতে

২৫ ভাগও বেচাকেনা হয়নি ঈদবাজারে; পুঁজি হারিয়ে ছিটকে পড়েছেন প্রায় ২৭ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী; গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ কমে গেছে; প্রভাব পড়েছে ব্যাংক লেনদেনে
-

মহামারী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতি। বছরের মোট অর্থনৈতিক লেনদেনের প্রায় ৭৫ ভাগ হয় পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এবার চার ভাগের এক ভাগও লেনদেন হয়নি। ঈদকেন্দ্রিক নতুন জামা কাপড়, কসমেটিকস তৈরি কেনা বেচা থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা ই থমকে গেছে। পথে বসার উপক্রম হয়েছে অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বড় অংশ। বেতনভাতা বন্ধ হয়ে গেছে দোকান কর্মচারীদের।
দেশের প্রায় ৫৪ লাখ ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর প্রায় অর্ধেকই ইতোমধ্যে পুঁজি হারিয়ে ছিটকে পড়েছেন। এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর বড় একটি অংশই গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে সহায়তা করতো। কিন্তু এবার ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ হওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে তারা ভূমিকা রাখতে পারছেন না। এতে কমে গেছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যাংক লেনদেনেও। ব্যাংক ঋণের বড় একটি অংশ আদায় হতো ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। কিন্তু করোনার প্রভাবে বেশির ভাগই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। উপরন্তু যারা ক্ষুদ্র সঞ্চয় করেছিলেন তারাও তাদের পুঁজি ভেঙে খেয়ে ফেলেছেন। সামনে যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়ানোর জন্য ঝরে পড়া এ বিশাল জনগগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য নগদ অর্থ প্রণোদনা দেয়ার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যাংকারদের শীর্ষ সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এর সাবেক সভাপতি এবং মিউচুয়াল ট্র্যাস্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেছেন, সারা বছরের অর্থনৈতিক কর্মকাে র প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই হয় পরিত্র রমজান ও ঈদ বাজারে। কিন্তু করোনার প্রভাবে এ বছর তা থমকে গেছে। বিভিন্ন ঋণগ্রহীতার কাছ থেকেও ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি জানান, ব্যাংকের মোট ঋণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ছিল অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে। তারা প্রায় প্রতি দিনই ব্যাংকে লেনদেন করতো। প্রতি দিনের লাভ থেকে তারা ব্যাংকের অর্থ ফেরত দিতো। ফলে খাতভিত্তিক ব্যাংকের ঋণ আদায়ের মধ্যে এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি আদায় হতো। বলা চলে ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে তেমন কোনো ঋণই খেলাপি হয়নি।
রাজধানীসহ দেশব্যাপী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশই ব্যবসার পুঁজি হারিয়ে পথে বসে গেছেন। অনেকেই আশা করেছিলেন এবারের ঈদ বাজারে কিছুটা লোকসান কাটাতে পারবেন, কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গত বছরের মতো এবারো ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো: হেলাল উদ্দিন গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বিআইডিএস’র হিসাব মতে, দেশে ৫৪ লাখ অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রয়েছেন। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মহামারী করোনার ধাক্কায় ছিটকে পড়ছেন ব্যবসার মূল স্রোত থেকে। লোকসান সামাল দিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত গুটিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসা। লকডাউনে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও তাদের ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। এ সময় তাদের আয় পুরোপুরি বন্ধ। তিনি বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাবে ইতোমধ্যে এর অর্ধেকই পুঁজি হারিয়ে ব্যবসা থেকে ঝরে পড়েছেন। যারা আছেন তারাও পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
হেলাল উদ্দিন বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে গত বছর ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারিয়েছেন। এবার ঋণ করে ব্যবসায়ীরা পয়লা বৈশাখ ও ঈদের বাজার ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্যবসায়ীদের ভাগ্যে সেটিও হলো না। এখন ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারিয়ে খুবই কষ্টে আছেন। এই মুহূর্তে সরকারের কাছে দাবি যেকোনোভাবেই হোক ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে নগদ টাকা পৌঁছে দিতে হবে। নগদ টাকা ঋণ হোক কিংবা বিনাশর্তে প্রণোদনা হোক তা ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এটি না করলে দেশের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করেন হেলাল উদ্দিন।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত ৫ এপ্রিল থেকে সরকারের ঘোষিত লকডাউনে সারা দেশে দোকানপাট ও শপিংমল বন্ধ রাখা হয়। গত ২৫ এপ্রিল থেকে শর্তসাপেক্ষে দোকানপাট খুলে দেয়া হয়। এতে ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পথে বসেছেন। তারা জানিয়েছেন, গত বছরের শুরুতে দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে শুরু করলে ওই বছরের ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, যা কয়েক দফায় বাড়ানোর পর গত বছরের ৩০ মে শেষ হয়। সেই সময়ে ওষুধের দোকান ছাড়া সব ধরনের দোকানপাট ও শপিংমল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এবারও করোনা সংক্রমণ রোধে ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন শুরু হয় যা ১৪ এপ্রিল থেকে কড়া লকডাউনে রূপান্তরিত হয়।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সারা দেশের অর্থনৈতিক লেনদেনের প্রায় ৭৫ শতাংশ হয় পবিত্র রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে। ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বছরের অন্য সময়ের চেয়ে এই সময়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। ঈদের সামনে গ্রাহকদের পণ্য কেনাকাটা বেড়ে যাওয়ায় নিয়মিত কর্মচারীদের বাইরেও গ্রাম থেকে বাড়তি লোক আনা হয়। রমজানের সারা মাস বেচাকেনা শেষে এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর বড় একটি অংশ ঈদের দিন বা ঈদের পরের দিন গ্রামের দিকে ছুটে যান। গ্রামে থাকা পরিবার-পরিজনের কাছে অর্থ পাঠান অনেকেই। এভাবেই ঈদকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকা গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বেড়ে যায় গ্রামের টাকার প্রবাহ। শুধু তাই নয়, বাড়তি পোশাক, কসমেটিক্সসহ অন্যান্য পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় শিল্পে বাড়তি উৎপাদন করতে হয়। আবার এসব পণ্যের কাঁচামালের জন্য বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে হয়। আর পণ্য আমদানিতে ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয়। এভাবে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকা বেড়ে যায় এ ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতিকে ঘিরে। কিন্তু গত বছরের মতো এ বছর ব্যতিক্রম হয় এ চিরাচরিত চিত্র থেকে। মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাবে এ বছর ঈদে তেমন কোনো কেটাকাটা করতে আসেননি গ্রাহকরা। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দোকান ভাড়া, কর্মচারীদের বেতনভাতা পরিশোধ এবং বিদ্যুৎসহ ইউটিলিটি বিল পরিশোধের জন্য ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির প্রেসিডেন্ট মো: আলা উদ্দিন মালিক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, দেশের ১৭ কোটি মানুষের ৯৫ শতাংশ পোশাকের চাহিদা তারা পূরণ করে থাকেন। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা যেমন সাশ্রয় হয়, তেমনি দেশের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। কিন্তু গত বছরের মতো এ বছরও তাদের ব্যবসা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গেছে। কারণ, রমজানের প্রায় এক মাস আগে তারা সারা দেশে সরবরাহের জন্য পোশাক তৈরি করেন এবং তা সারা দেশে পাইকারি দরে বিক্রি করেন। ঈদের জন্য সাধারণত আলাদা ডিজাইনের পোশাক হয়, যা বছরের অন্য সময়ের জন্য খুব একটা চলে না। এ বছর তাদের নিজস্ব পুঁজি ও মহাজনি ধারদেনা করে রমজানের এক মাস আগে সারা দেশে সরবরাহ করার জন্য পোশাক বানিয়েছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় গত ৫ এপ্রিল থেকে আজ পর্যন্ত ঢাকার সাথে গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। সারা দেশের সাথে যোগাযোগ বন্ধ থাকায় মফস্বল থেকে ঢাকা পাইকারি বাজারে পোশাক, কসমেটিক্স কেনার জন্য গ্রাহক আসতে পারেননি। ব্যবসার ভরা মৌসুমে লকডাউনের কারণে তাদের মোট উৎপাদনের ২৫ ভাগও বিক্রি করতে পারেননি। এতে তারা ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে পড়ে গেছেন।
তিনি বলেন, এমনিতেই পয়লা বৈশাখ কেন্দ্রিক বাজার বন্ধ থাকায় তাদের পুঁজির বড় একটি অংশ আটকে গেছে। এবার আবার ঈদেরবাজারে পুঁজি আটকে যাওয়ায় তাদের পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন, সরকার থেকেও আজ পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না। ইতোমধ্যে পুঁজি হারিয়ে অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। এবার উৎপাদিত পোশাক বিক্রি করতে না পারায় আরেকবার পুঁজি আটকে গেলো। ফলে সামনে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে পোশাক সরবরাহ করার মতো উদ্যোক্তার সংখ্যা কমে যাবে। আর এ খাতে সহযোগিতা না করলে সামনে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। এতে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রাই ব্যয় হবে না, পাশাপাশি লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে যাবে। এ কারণে দেশের বড় এ খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোশকতা অতীব প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।


আরো সংবাদ



premium cement