২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`
আইএইচএমইর বিশ্লেষণ

বিশ্বে করোনায় মৃত্যু সরকারি হিসাবের দ্বিগুণেরও বেশি

-

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এ ভাইরাস। সে সময় থেকে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৯ লাখ মানুষ মারা গেছেন। এটি বিভিন্ন দেশ যে সরকারি হিসাব দিয়েছে, তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের (আইএইচএমই) বিশ্লেষণে এমন আভাস পাওয়া গেছে। এই বিশ্লেষণেও শুধু সরাসরি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হিসাব করা হয়েছে। মহামারীর কারণে সৃষ্ট চিকিৎসা সঙ্কটে যেসব মৃত্যু হয়েছে, তা হিসাবে ধরা হয়নি। সরকারি তথ্যের ভিত্তিতেই করোনাভাইরাস পরিস্থিতির নিয়মিত আপডেট দিয়ে আসছে ওয়ার্ল্ডোমিটারসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট। ওয়ার্ল্ডোমিটারের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন পৌনে ৩৩ লাখ লোক। এ সংখ্যা আইএইচএমইয়ের দেয়া মৃত্যুর হিসাবের অর্ধেকেরও কম।
বিশ্বের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার তুলনামূলক হিসাব তুলে ধরা একটি স্বাধীন স্বাস্থ্য গবেষণা সংস্থা আইএইচএমই। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ দেশ শুধু হাসপাতালে মারা যাওয়া রোগীদের গণনা করায় মৃতের প্রকৃত সংখ্যা গোপন থেকে যাচ্ছে। মহামারী-পূর্ব সময়ে সব ধরনের কারণে মৃত্যুর প্রবণতার সাথে মহামারীর সময়ে সর্বমোট মৃত্যুর সংখ্যার তুলনামূলক হিসাব করে করোনায় মৃত্যুর সম্ভাব্য প্রকৃত সংখ্যা বের করেছে আইএইচএমই। তাদের হিসাব বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত করোনায় অন্তত ৯ লাখ ৫ হাজার মানুষ মারা গেছেন। অথচ দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) হিসাবে বলা হচ্ছে, সেখানে করোনায় মৃতের সংখ্যা ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৪৯১ জন।
সব রেকর্ড ছাড়াল ভারতে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা : ভারতের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল শুক্রবার দেশটিতে নতুন করে শনাক্ত হয়েছে চার লাখ ১৪ হাজারের বেশি রোগী, যা বিশ্বের যেকোনো দেশেই এক দিনে সর্বোচ্চ শনাক্তের পরিমাণ। এ ছাড়া এ দিন নতুন করে মৃত্যু হয়েছে আরো তিন হাজার ৯১৫ জনের। ভারতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। গত ১ মে দেশটিতে দৈনিক সংক্রমণ প্রথমবারের জন্য চার লাখ ছাড়ায়। তার পর চার দিন চার লাখের নিচেই ছিল নতুন শনাক্তের সংখ্যা। তবে বৃহস্পতিবার শনাক্ত হয় চার লাখ ১২ হাজারের বেশি। আর শুক্রবার সেই সংখ্যাও ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে দেশটিতে সক্রিয় রোগী ৩৬ লাখ ৪৫ হাজার ১৬৪ জন।
গত ১ মার্চেও ভারতে এক দিনে শনাক্ত হয়েছিল মাত্র ১৫ হাজার ৫১০ জন রোগী। সেই দেশেই দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন তিন লাখের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। করোনা মহামারীতে ভারতের প্রায় দুই লাখ ৩৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর এই সপ্তাহে ভারতের মোট আক্রান্ত দুই কোটি ছাড়িয়ে যায়।
আসছে স্পুটনিকের সিঙ্গেল ডোজ ভ্যাকসিন : রাশিয়ার উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিনের এক ডোজের একটি সংস্করণ অনুমোদন করেছে দেশটির কর্মকর্তারা। গত বৃহস্পতিবার অনুমোদন পাওয়া এই টিকাটিকে ‘স্পুটনিক লাইট’ নামে অভিহিত করছেন তারা। তবে রুশ কর্মকর্তারা বলছেন, দুই ডোজের স্পুটনিক টিকার চেয়ে এক ডোজের টিকাটি একটু কম কার্যকর। রাশিয়ান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (আরডিআইএফ) বলছে, এক ডোজের টিকাটি ৭৯.৪ শতাংশ কার্যকর। অন্য দিকে দুই ডোজের ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা ৯১.৬ শতাংশ।
ভারত থেকে ফ্লাইট চালু করবে অস্ট্রেলিয়া : করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে ভারতে আটকা পড়া নাগরিকদের দেশে ফেরাতে ব্যর্থতার জন্য সমালোচিত হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। আর এর পরই ভারত থেকে নাগরিকদের ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। চলমান ফ্লাইট নিষেধাজ্ঞা আগামী ১৫ মে শেষ হওয়ার পর তা আবারো চালুর ঘোষণা দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী। ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়ায় যাতায়াত গত ২৭ এপ্রিল থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়। আগামী ১৫ মে পর্যন্ত এই ফ্লাইট বন্ধ রাখা হবে। এ সময়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকরা দেশে ফিরলে জেল কিংবা জরিমানার মুখোমুখি হতে পারে। পরে সমালোচনার মুখে পড়ে গতকাল শুক্রবার এ হুমকি প্রত্যাহার করে নেন তিনি।
এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা : করোনা ছুঁয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টকেও। সেখানের বেস ক্যাম্পেও ক্রমে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। গত মাসে প্রথমবার বেসক্যাম্পে এক বিদেশী পর্বতারোহীর শরীরে করোনা সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। নেপাল সরকারের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বেস ক্যাম্পে চারজনের শরীরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রমাণ মিলেছে। যদিও বেসরকারি মতে সেই সংখ্যাটি ৩০। ২০২০ সালে এভারেস্টে ওঠার অনুমতি দেয়া হয়নি, সে কারণেই এ বছর রেকর্ডসংখ্যক পর্বতারোহীকে অভিযানের অনুমতি দেয় নেপাল সরকার। কিন্তু এবারের অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকেই একের পর এক করোনা আক্রান্তের খবর আসতে থাকে।
প্রকট হয়েছে ক্ষুধা ও মাতৃস্বাস্থ্য সঙ্কট Ñজাতিসঙ্ঘ : কোভিড-১৯ মহামারী প্রকট করে তুলেছে ক্ষুধা। মারাত্মক অবনতি ঘটাচ্ছে মায়েদের স্বাস্থ্যসেবার। ঝুঁকিতে পড়েছে কোটি কোটি মানুষ। বিশ্বে গরিবরাই এ পরিস্থিতিতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে বেশি। জনসংখ্যা তহবিল এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সাথে সম্মিলিত দু’টি প্রতিবেদনে গত বুধবার জাতিসঙ্ঘ এ কথা জানায়।
এতে বলা হয়, ২০২০ সালে বিশ্বে জরুরি খাদ্য সাহায্য দরকার এমন মানুষের সংখ্যা পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। অঙ্কের হিসাবে যা অন্তত ১৫ কোটি ৫০ লাখ। আর প্রয়োজনীয় ধাত্রীর অভাবে মা ও শিশুর মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে গেছে। ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে ৫৫টি দেশ এবং অঞ্চলের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে আছে বুরকিনা ফাসো, দক্ষিণ সুদান ও ইয়েমেন। এসব দেশের অনন্ত এক লাখ ৩৩ হাজার মানুষ ক্ষুধা সঙ্কটের সবচেয়ে গুরুতর পর্যায় দুর্ভিক্ষের মধ্যে আছে। আর ৩৮টি দেশের অন্তত দুই কোটি ৮০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষ থেকে মাত্র এক ধাপ দূরে আছে, বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জাতিসঙ্ঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনপিএফ) দ্বিতীয় প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বিশ্বজুড়ে লাখো ধাত্রীর অভাব দেখা দিয়েছে। এতে নারী ও নবজাতকরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না। ধাত্রীসেবাও বিঘিœত হচ্ছে এবং তাদেরকে অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবার কাজে লাগানো হচ্ছে।
দিল্লিকে প্রতিদিনই ৭০০ মেট্রিক টন অক্সিজেন দিতে হবে : ভারতের কেন্দ্র সরকারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত রাজধানী দিল্লির হাসপাতালের জন্য দৈনিক ৭০০ মেট্রিকটন মেডিক্যাল অক্সিজেন অবশ্যই বরাদ্দ করার নির্দেশ দিয়েছে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। ভারতের যেসব এলাকায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ লাগামহীন গতিতে বাড়ছে, রাজধানী দিল্লি তার অন্যতম। সেখানে গত কয়েক সপ্তাহে কয়েকটি হাসপাতালে অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ায় অল্প সময়ের ব্যবধানে অনেক কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন। এ অবস্থায় গতকাল শুক্রবার সকালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ নির্দেশ দেয়।
পেটেন্ট উন্মুক্তের পক্ষে রাশিয়া ফ্রান্স ইতালি, বিপক্ষে জার্মানি : করোনাভাইরাসরোধী টিকার পেটেন্ট বা মেধাসম্পদ উন্মুক্তের প্রস্তাবে সায় দিয়েছে রাশিয়া, ফ্রান্স ও ইতালি। তবে এখনো এর ঘোর বিরোধী জার্মানি। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, তারা এই ইস্যু নিয়ে আলোচনায় বসতে রাজি। করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় টিকাসহ জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জামগুলোর পেটেন্ট উন্মুক্ত করার দাবি জানিয়ে গত অক্টোবরে ডব্লিউটিওতে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এ পর্যন্ত তাদের ওই প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে ১০০টিরও বেশি দেশ। পেটেন্ট উন্মুক্ত হলে বিশ্বজুড়ে টিকার উৎপাদন বাড়বে এবং দরিদ্র দেশগুলোর টিকাপ্রাপ্তির পথ আরো সুগম হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারতে করোনা মোকাবেলায় ফাউসির তিন পরামর্শ : ভারতে করোনা মহামারীর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আমেরিকার শীর্ষ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসি ‘জরুরি ব্যবস্থা’ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী ব্যবহার করে দেশটিতে অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি, লকডাউন জারি করে সংক্রমণ শৃঙ্খল ভাঙার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বিশ্বের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি সিএনএনে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি ভারতে করোনা মোকাবেলা নিয়ে এসব পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, গত বছর শীতের শুরুতে আমেরিকাতে যে অবস্থা হয়েছিল ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি তার থেকেও খারাপ। এ সংক্রমণ শৃঙ্খল ভাঙতে লকডাউন জারি করা প্রয়োজন। এর জন্য দুই-চার-ছয় যতটা সপ্তাহ দরকার, তা করতে হবে। পাশাপাশি যত বেশি সম্ভব টিকা দিতে হবে। সেটি করতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে পড়তে হবে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement