২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ঈদ সামনে রেখে সক্রিয় মৌসুমি অপরাধীরা

ভোরের ঢাকায় তৎপর ছিনতাই চক্র
-

ঈদ ঘিরে সক্রিয় হয়েছে উঠেছে মৌসুমি অপরাধী চক্র। শুধু রাজধানী ঢাকা শহরেই নয়, দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতেও প্রতারণার নানা ফাঁদ পেতে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে।
ঈদ এগিয়ে আসায় ধীরে ধীরে লকডাউন শিথিল হচ্ছে। ফলে বেড়েছে মানুষের অবাধ চলাফেরা। শপিংমলগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। বেড়েছে মানুষের চলাচল, বেড়েছে যানচলাচল। আর এ সুযোগেই তৎপরতা শুরু করেছে অপরাধীরা। ছিনতাইকারী, জাল নোট কারবারি, মলমপার্টি-অজ্ঞানপার্টি, চাঁদাবাজ চক্রসহ নানা ধরনের অপরাধী এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঢাকা শহরে। তবে আগে থেকেই সতর্ক অবস্থানে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় ছিনতাইসহ মৌসুমি অপরাধী ধরতে এরই মধ্যে অভিযান শুরু করেছে ডিবির একাধিক টিম। সেই সাথে কাজ করছে পুলিশ ও র্যাব। বড় অঙ্কের অর্থ বহনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মানি এস্কর্ট সেবা দিচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
রাজধানীর শান্ত, কোলাহলমুক্ত ভোরকে ভয়ঙ্কর করে তুলছে বেপরোয়া ছিনতাইকারীরা। নগরীর অনিন্দ্য সুন্দর সকালের পিচঢালা পথকে রক্তাক্ত করে তুলছে তারা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভোর কিংবা গভীর রাতে ঘটছে এসব ছিনতাইয়ের ঘটনা। পুলিশ বলছে, ঘটনাপ্রবণ এলাকায় বাড়তি নজর রয়েছে তাদের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছিনতাইয়ে জড়িতদের বেশির ভাগই কিশোর, উঠতি তরুণ ও গাড়িচালক। পুলিশ জানিয়েছে, কিছু ভুক্তভোগী মামলা করেন, অনেকেই করেন না। কোনো থানা যদি ছিনতাইয়ের মামলা না নিতে চায়, তবে ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের জানাতে বলেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এ দিকে বিভিন্ন পেশাজীবীর মধ্যে কারা কারা ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
রাজধানীতে বিভিন্ন সময় ঘটে যাওয়া ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চলতি পথে কিংবা রিকশায় করে যাতায়াতের সময় আচমকা টান। মুহূর্তেই সবকিছু নিয়ে চম্পট ছিনতাইকারী। ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে নিজেদের ভারসাম্য রাখতে না পেরে ভুক্তভোগীদের অনেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হচ্ছেন। সেই সাথে নিহত হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। যার সবশেষ উদাহরণ রাজধানীর মুগদায় গতকাল বুধবার ভোরে সুনিতা রানী দাস নামে এক নারীর মুত্যু। ছিনতাইকারীরা তার ব্যাগ ধরে হ্যাঁচকা টান দিলে রিকশা থেকে পড়ে ওই নারীর মৃত্যু হয়।
জানা গেছে, ভোর ৬টার দিকে সুনিতা তার গোপীবাগের বাসা থেকে পাশের বৌদ্ধমন্দিরে ভাগ্নেকে নিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলেন। প্রাইভেট কারে কয়েকজন ছিনতাইকারী পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সুনিতার ব্যাগ ধরে টান দেয়। এ সময় রাস্তায় পড়ে গেলে তার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগে। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় সুনিতার।
গত সোমবার রাত ১২টার দিকে রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে মামুন অর রশিদ (৪৫) নামের এক কাপড় ব্যবসায়ী আহত হয়েছেন। তার কাছ থেকে ১৯ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। আহত ব্যবসায়ী জানান, সোমবার রাতে যাত্রাবাড়ীর একটি মার্কেটের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড শেষ করে মোটরসাইকেলে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার বাসায় যাওয়ার সময় হানিফ ফ্লাইওভারের উপরে তিনি-চারজন ছিনতাইকারী তার গতি রোধ করে। তিনি বলেন, তারা আমার কাছে যা আছে সব কিছু দিতে বলে। দিতে না চাইলে তখন তারা আমার হাতে-পায়ে ছুরিকাঘাত করে টাকা ও মোবাইল নিয়ে পালিয়ে যায়।
এর আগে গত ২৮ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানীর পলাশী এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে সাগর (২৫) ও ইমরান (২১) নামে দুই যুবক আহত হন। পরে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। এ সময় দুর্বৃত্তরা তাদের কাছ থেকে চার হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আহত ইমরান বলেন, গুলিস্তান বঙ্গবাজারে এনেক্স টাওয়ারের সামনে শরবত বিক্রি করি আমি ও সাগর। ভোরে দু’জন মিলে পলাশীর মোড় দিয়ে কাওরান বাজার যাচ্ছিলাম লেবু কিনতে। পলাশী মোড় থেকে রিকশা নেয়ার সময় ছিনতাইকারীরা তাদের পথ রোধ করে পকেট থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। বাধা দিলে তারা সাগরের ডান পায়ে ও পেটে ছুরিকাঘাত করে। আমাকেও বাম হাতে ছুরিকাঘাত করে তারা। পরে সাগরের সাথে থাকা সাড়ে তিন হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোন এবং আমার কাছ থেকে ৭০০ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় তারা। নগরীতে প্রায়ই এরকম ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই পুলিশের কাছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, সম্প্রতি দেখেছি কিছু ছিনতাইয়ের সাথে গাড়িচালক, কলেজশিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ জড়িয়ে পড়ছে। এর কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। কেউ দ্রুত টাকা আয় করতে চায়, কেউ লোভে পড়ে আবার কেউ অন্যের প্ররোচনায় পড়ে ছিনতাইয়ে জড়াচ্ছে। অনেকে আবার কারাগারে গিয়ে ছিনতাই চক্রের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। জেল থেকে বের হয়েই শুরু করে ছিনতাই। আমরা চক্রগুলোকে ধরতে চাই। ভুক্তভোগীরা মামলা না করলে আমাদের জন্য কাজটা কঠিন হয়ে যায়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন ঈদকে ঘিরে বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে প্রতারকদের তৈরি কোটি টাকার জাল নোট। জাল টাকা তৈরির সাথে জড়িত চক্রগুলো সারা বছর তৎপর থাকলেও উৎসবে বড় টার্গেট নিয়ে মাঠে নামে তারা। এ সময় মুদি দোকান থেকে শপিংমল সবখানে থাকে উপচে পড়া ভিড়। এ সুযোগে জাল নোটগুলো মাঠে ছাড়ে চক্র। অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ব্যাংকে লেনদেন ও এটিএম বুথেও জাল টাকা ছড়িয়ে দেয়া হয়। তবে জাল নোটের এসব চক্র ধরতে মাঠে সক্রিয় রয়েছে ডিবি। ঈদকে সামনে রেখে জাল টাকা কারবারি চক্রের সদস্যদের ধরতে মাঠে রয়েছে গোয়েন্দারা। তারই ধারাবাহিকাতয় গত রোববার রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকায় জাল টাকার মিনি কারখানায় অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় এক নারীসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, গ্রেফতারদের হেফাজত থেকে জব্দ করা হয়েছে তৈরি করা ৪৬ লাখ জাল টাকা ও জাল টাকা তৈরির বিপুল সামগ্রী।
তিনি বলেন, চক্রটি প্রথম দিকে সাভারের গেন্ডা এলাকায় জাল টাকা তৈরি করত। ঈদকে কেন্দ্র করে তারা কামরাঙ্গীরচরে জাল টাকা তৈরির ব্যবসা শুরু করে গত তিন মাস ধরে। চক্রটির দলনেতা জীবন। এর আগেও জাল টাকা তৈরির সাথে জড়িত থাকার কারণে তার একাধিকবার জেল হয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে সে আবার জাল টাকা বানানোর কাজ শুরু করে। জীবনকে বেশ কিছু দিন ধরে পুলিশ অনুসরণ করছিল। অবশেষে সে ধরা পড়ে। গ্রেফতারদের মধ্যে পিয়াস ও ইমাম হোসেন বরিশাল পলিটেকনিক থেকে নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারিং ও কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে ডিপ্লোমা করেছেন। ইমাম নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন। অপর আসামি পিয়াস বরিশাল সরকারি পলিটেকনিক কলেজ থেকে পাওয়ারের ওপর ডিপ্লোমা করেন। বেশি টাকা পাওয়ার লোভে ভালো চাকরি ছেড়ে দিয়ে জাল টাকা তৈরির অবৈধ কাজে জড়িয়ে যান দু’জনই।
ডিসি মশিউর বলেন, গ্রেফতারদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় দু’টি ল্যাপটপ, দু’টি প্রিন্টার, হিট মেশিন, বিভিন্ন ধরনের স্ক্রিন, ডাইস, জাল টাকার নিরাপত্তা সুতা, বিভিন্ন ধরনের কালি, আঠা, স্কেল ও কাটারসহ বিভিন্ন সামগ্রী, যা দিয়ে আরো অন্তত দেড় কোটি জাল টাকা তৈরি করা সম্ভব হতো। তিনি বলেন, এই দুই ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারের তৈরি জাল টাকার কোয়ালিটি যথেষ্ট উন্নত। খালি চোখে দেখে বোঝারই উপায় নেই এগুলো জাল। আসন্ন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে লক্ষ্য করে জাল টাকা তৈরি করার বড় ধরনের পরিকল্পনা ছিল তাদের।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, পবিত্র ঈদ সামনে রেখে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল, বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে। তারা চেতনানাশক ওষুধ মেশানো খাদ্যদ্রব্য হিসেবে চা, কফি, জুস, ডাবের পানি, ক্রিম জাতীয় বিষ্কুটসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রির নামে সাধারণ মানুষকে খাইয়ে অজ্ঞান করে সব নিয়ে নিচ্ছে। কখনো কখনো অজ্ঞান ব্যক্তির মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তার স্বজনদের কাছ থেকে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বিকাশ ও অন্যান্য মাধ্যমে মুক্তিপণও আদায় করে। জানা গেছে, গত সোমবার ধানমন্ডিতে লিটন কবিরাজ (৫৫) নামের এক ব্যক্তির সিএনজি নিয়ে গেছে অজ্ঞানপার্টির লোকেরা। তাকে অজ্ঞান করে ফেলে গেছে আবাহনী মাঠের পাশে। পরে অজ্ঞান পার্টির লোকেরা ফোন করে জানিয়েছে, এক লাখ টাকা পাঠালে ওই সিএনজি তারা ফেরত দেবে।


আরো সংবাদ



premium cement