২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. মুস্তফা কে মুজেরি

গ্রামীণ অর্থনীতি ও অনানুষ্ঠানিক খাতের দ্রুত পুনর্বাসন জরুরি

-

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ অনেক বেশি মারাত্মক। সংক্রমণ ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে এটা অনেক মারাত্মক। আগামী দিনগুলোতে কত দিন এই পরিস্থিতি চলবে, আরো কত দূর নিয়ে যাবে তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। করোনার দুই দফা আঘাতে গ্রামীণ অর্থনীতি ও অনানুষ্ঠানিক খাতগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই এই দুই খাতের দ্রুত পুনর্বাসন জরুরি বলে মনে করছেন বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এবং বর্তমানে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি। নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, অর্থনীতির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বাজেটে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। গত এক বছরের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকে প্রণোদনা প্যাকেজগুলোকে পরিপূর্ণভাবে সাজাতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে বরাদ্দ সহায়তা যথাযথভাবে পৌঁছাতে হবে।
নিচে তার সাক্ষাৎকারটির বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
নয়া দিগন্ত : কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে গোটা বিশ্বে অচলাবস্থা চলছে। এখন অর্থনীতিতে এর অভিঘাত কতটা গুরুতর হবে বলে মনে করেন?
ড. মুস্তফা কে মুজেরি : প্রথম আঘাত আমাদের অর্থনীতিকে অনেকভাবেই সংক্রমিত করে। আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই অভিঘাতের প্রভাব দেখেছি। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। আমরা এই জনগোষ্ঠীকে খুব বেশি সুরক্ষা দিতে সক্ষম হইনি। স্বাস্থ্য খাতে আমাদের যে ধরনের প্রস্তুতি ছিল তাতে বেশ কিছু জায়গায় রোধ করা গেছে। কিন্তু দুর্বলতাও লক্ষ করা গেছে। প্রথম অভিঘাত আমাদের জন্য অতটা মারাত্মক হয়নি, যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল। যার ফলে কিছুটা হলেও আমাদের সহ্য করার ক্ষমতাটা ছিল। করোনার দ্বিতীয় যে ঢেউ শুরু হয়েছে এটা অনেক বেশি মারাত্মক। সংক্রমণের ক্ষেত্রে, মৃত্যুর ক্ষেত্রে এটা অনেক মারাত্মক। আগামী দিনগুলোতে কত দিন এই পরিস্থিতি চলবে, আরো কোথায় যাবে এটা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে এখন প্রথম অভিঘাতের ধাক্কাটা সামলে ওঠার আগেই আরো বড় ধাক্কা এসেছে। ফলে আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠেীর কোপিং ক্যাপাসিটি অনেকটাই বাইরে চলে গেছে। লকডাউনসহ যাই বলছি না কেন, এটাকে তারা এখন মেনে চলতে পারছে না। তাদেরকে তো বেঁচে থাকতে হবে। তাদের সামনে এখন পথ দুটোÑ করোনায় মৃত্যু বা না খেয়ে মৃত্যু। এ ছাড়া আমাদের রফতানির বড় ভরসা হলো তৈরী পোশাক খাত। এটা পুরোপুরি নির্ভর করে আন্তর্জাতিক চাহিদার উপর। বিদেশী বাজার বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারগুলো যদি ঘুরে না দাঁড়ায় আমাদের রফতানি কমে যাবে। তাই যখনই তাদের চাহিদা শুরু হবে তখনই যেন সেটি পূরণ করতে পারি সে প্রস্তুতিটা আমাদের নিয়ে রাখতে হবে। আমাদের প্রবৃদ্ধি যে এত দ্রুত এগিয়েছে তার প্রধান শক্তি হলো গ্রামীণ অর্থনীতি ও অনানুষ্ঠানিক খাতগুলো। এই অনানুষ্ঠানিক খাতটাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে করোনার দু’দফা আঘাতে। অর্থনীতির চালিকাশক্তিকে যদি আবার দৃঢ়তার সাথে পুনর্বাসিত করতে না পারি তাহলে অর্থনীতি দুর্বল হবে। আমাদের লক্ষ্যমাত্রায় আমরা পৌঁছাতে পারব না। আমাদের প্রবৃদ্ধির হারকে যদি কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারি তাহলে অন্য খাতগুলোও ঘুরে দাঁড়াবে। আমাদের রেমিট্যান্সে অতটা আঘাত হয়নি। তবে দীর্ঘকালীন একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে।
নয়া দিগন্ত : করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ কী কী?
ড. মুস্তফা কে মুজেরি : আমাদেরকে দ্রুততার সাথে এগিয়ে যাওয়াকে ব্যাহত করেছে করোনার প্রথম ধাক্কা। কোনো চলন্ত গাড়িকে কোনো কারণে যদি থামতে হয়, তাহলে তাকে পুনরায় শক্তি পেতে সময় লাগবে। আমাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রেও তাই, আমরা অনেকটাই পিছিয়ে গেছি। অর্থাৎ এগিয়ে যাওয়ার গতিটা অনেকাংশে কমে গেছে। ক্ষতি কাটিয়ে উঠে আগের গতিতে ফিরে যেতে সময় লাগবে। আমাদের মেগা প্রকল্পগুলো বিশেষ করে পদ্মা বহুমুখী সেতু, মেট্রোরেল ইত্যাদি চালু হলে অর্থনীতিতে বড় একটা অবদান রাখবে। পদ্মা সেতুর কাজ করোনার কারণে কিছুটা হলেও গতি কমেছে। আমরা যদি এসব বড় প্রকল্প নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারি তাহলে আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জন ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে এগুলো। আগামী এক-দু’বছরের মধ্যে যেসব মেগা প্রকল্প চালু করা সম্ভব সেগুলো যেন কোনো অবস্থাতেই আর বিলম্ব না হয় সে দিকে বিশেষ নজর দেয়া দরকার। আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য মনোযোগ ও জোর দিতে হবে। কারণ এটা তো আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। রফতানি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। যদি বাইরের অর্থনীতি ঘুরে না দাঁড়ায় তাহলে আমাদের রফতানি বাড়বে না। আমাদের রফতানি তো একটা পণ্যÑ রেডিমেড গার্মেন্ট-নির্ভর। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াবার জন্য বিশেষ করে গ্রামীণ ও অনানুষ্ঠানিক খাতের জন্য যে ধরনের সহায়তা দরকার তা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনে যেমন সহায়তা করে, তেমনি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় অর্জন ও কর্মসংস্থানে ভূমিকা পালন করে। বাজেটেও বিশেষ নজর দিতে হবে; করোনার প্রতিঘাত যদি আমরা দ্রুততার সাথে কাটিয়ে উঠতে চাই।
নয়া দিগন্ত : রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি আছে। আসছে নতুন বাজেট। এ ক্ষেত্রে বাজেট তৈরিতে সরকারকে কী কী পদক্ষেপ ও দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে বলে আপনার পরামর্শ?
ড. মুস্তফা কে মুজেরি : বাজেটের মাধ্যমে এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সাপোর্ট দিয়ে শক্তিশালী করা খুবই প্রয়োজন। এদেরকে সাপোর্ট না দিলে যত আমরা মাস্কের কথা বলি, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কথা বলি বা স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলি, কোনোটই গুরুত্ব পাবে না। ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র মানুষকে সহায়তা দেয়ার বিষয়টি বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষ বেঁচে না থাকলে উন্নয়ন কার জন্য হবে। তারাই হলো আমাদের উন্নয়নের শক্তি ও লক্ষ্য। করোনার কারণে আমাদের অর্থনীতিতে উন্নয়নে যেসব বাধার সৃষ্টি হয়েছে তা দ্রুত দূর করার জন্য বাজেটে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের শিক্ষা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটা বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে, যেন যখনই সুযোগ আসে আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্বাসন করতে পারি। ক্ষতিটাকে কাটিয়ে উঠতে শিক্ষা খাতের জন্য একটা পরিকল্পনা নেয়া উচিত। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অধীনে অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে করোনা-পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য একটা পরিকল্পনা দ্রুত নেয়া উচিত। সেখানে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ দেয়া দরকার।
নয়া দিগন্ত : সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা কতটা বাস্তব কার্যকর হয়েছে আপনি মনে করেন? ধাক্কা মোকাবেলায় বা সামাল দিতে কী করণীয় বলে মনে করেন?
ড. মুস্তফা কে মুজেরি : সরকার সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে বা অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষের কাছে এই সহায়তাটা খুব একটা পৌঁছেনি। এর দুটো কারণ, তাদেরকে টার্গেট করে সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, তাদের কাছে পৌঁছানো নিয়েও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে। সরবরাহ কিভাবে করবে তার কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই। তাদের জন্য সহায়তা কর্মসূচি নেয়া একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এটা না করলে তাদের দুর্দশা লাঘব করা সম্ভব হবে না। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করার যে পদক্ষেপ আছে সেগুলোও অতটা ফলপ্রসূ হবে না। আমাদের সামনে করণীয় হলো, করোনার এই পরিস্থিতি দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করতে হবে। যদিও দুর্বলতা এখনো লক্ষণীয়। প্রতিদিনই দেখতে পাচ্ছি, স্বাস্থ্যবিধি কোনোভাবেই আমরা মেনে চলতে সক্ষম হচ্ছি না। অনেকাংশে এসবকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। মানুষের কোনো উপায় নেই। তাদের তো বের হতেই হবে। ঘরে বসে থাকলে তো চলবে না। সত্যিকার অর্থে অনেক প্রণোদনাই বাস্তবায়ন হয়নি। আবার যেসব ক্ষেত্রে প্রণোদনা ছিল খুব সুসংগঠিত সেগুলো বেশি বাস্তবায়ন হয়েছে। এসএমই-সহ ছোট খাতগুলোতে প্রণোদনার প্যাকেজ আরো কম বাস্তবায়ন হয়েছে। যারা ক্ষমতাশালী তারা পুরোপুরি না পারলেও অনেকটা বেশি সুবিধা নিতে পেরেছে। দুর্বল খাতগুলো নিতে পারেনি। দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে আমাদেরকেও ওই সব প্রণোদণার প্যাকেজগুলো পুনর্বিবেচনা করা দরকার। প্রয়োজন মতো তাতে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন করা উচিত। কারণ এক বছরে আমরা কিছুটা হলেও শিখেছি। নতুন শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের এই প্রণোদনা প্যাকেজকে পরিপূর্ণভাবে সাজাতে হবে। সেখানে শক্তিশালী খাতের গাইডলাইন এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের গাইডলাইন আলাদা করতে হবে।
নয়া দিগন্ত : ঘাটতি মোকাবেলায় বা সামাল দিতে কী করণীয় বলে মনে করেন?
ড. মুস্তফা কে মুজেরি : স্বাভাবিকভাবে অর্থনীতির গতি যদি কমে যায় তাহলে রাজস্ব আদায় কমে যাবে। যত দিন পর্যন্ত অর্থনীতিতে গতি না আসবে তত দিন পর্যন্ত আমরা রাজস্ব আদায় বাড়াতে সক্ষম হবো না। তবে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা জানি রাজস্ব আদায়ের অনেক ফাঁকফোকর রয়েই গেছে। তাই যতটা সম্ভব এই ফাঁকফোকর বন্ধ করে রাজস্ব আয় বাড়াতে হব। বাজেটের ক্ষেত্রে, বিদেশী সহায়তার ক্ষেত্রে একটা প্রচেষ্টা নিতে হবে। করোনার সময়ে আপৎকালীন একটা সহায়তা এডিবি ও বিশ্বব্যাংকও দিচ্ছে। এটাকে আমাদের ক্যাশ করতে হবে। যাতে দ্রুততার সাথে বৈদেশিক সহায়তা বাড়াতে পারি। আমরা যদি যৌক্তিক কোনো পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিতে পারি তাহলে বহির্বিশ্ব থেকে অর্থ পাওয়া অতটা দুষ্কর হবে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবেÑ পরিকল্পনাগুলো যাতে যৌক্তিক, শক্তিশালী ও ভালো হয়। খরচের ক্ষেত্রেও আমাদের সংযত হতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষিতে অনেক খরচ কিছুটা হলেও কমেছে। অনেকে চাইলেও বিদেশ ট্যুরে যেতে পারছে না। সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি কতটা ভালো হবে তা বলা যাচ্ছে না।
নয়া দিগন্ত : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
ড. মুস্তফা কে মুজেরি : আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনিও ভালো থাকবেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement