২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখা মূল চ্যালেঞ্জ

-

করোনার প্রথম অভিঘাত অর্থনীতির সব খাতেই আঘাত করেছে। এর ক্ষত না শুকাতেই আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এতে ক্ষতি আরো বাড়বে। এই ক্ষতি পোষাতে সচল শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। বন্ধ বা রুগ্ণ শিল্পগুলো চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন বিনিয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে মানুষের আয় বাড়ানো সম্ভব হবে। তখনই কেবল শিল্প খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। নয়া দিগন্তকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ যেভাবেই হোক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখা।
নিচে তার সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
নয়া দিগন্ত : কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে গোটা বিশ্বে অচলাবস্থা চলছে। এখন অর্থনীতিতে এর অভিঘাত কতটা গুরুতর হবে বলে মনে করেন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : কোভিড-১৯ আসার আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি সার্বিকভাবে অন্যান্য দেশের অর্থনীতির তুলনায়, বিশেষ করে আঞ্চলিক বা দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে মোটামুটি এগিয়ে ছিল। আবার কোডিভ আসার পরও তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো ছিল। কোভিডের প্রথম আঘাতের পর আমরা মোটামুটি এটা সামলে উঠার চেষ্টা করছিলাম। উঠছিলামও। হঠাৎ করে করোনার দ্বিতীয় এই ঢেউ আসাতে চ্যালেঞ্জটা বেড়ে গেল। এখন যা দরকার ছোট বড় সব ধরনের শিল্প, সেবা খাতকে একটু সচল করতে পারলে কর্মসংস্থান হবে। কৃষি, ছোট মাঝারি শিল্প, রেমিট্যান্সের আয় ধরে রাখা, রফতানি বহুমুখী করা। শুধু তৈরী পোশাক খাতের ওপর নির্ভর হলে চলবে না। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কর্মসংস্থান।
নয়া দিগন্ত : করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ কী কী?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের জন্য আমাদের ব্যাংকগুলোর কার্যকর ও অগ্রণী ভূমিকা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর ভূমিকা বরাবরই গতানুগতিক। এর প্রমাণ হচ্ছে, কোভিডের কারণে গত জুলাই মাসে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়ন সমানভাবে হয়নি। ছোট-বড় সব খাতের জন্য সুষম ছিল প্যাকেজগুলো। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অন্য যেসব নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা আছে সেগুলোর কর্মদক্ষতা বাড়াতে হবে। এদের কর্মদক্ষতা না বাড়ালে সরকারি নীতি-কৌশলগুলো তো বাস্তবায়ন হয় না। এসবের দক্ষতা বাড়ানোও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। ছোট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য যা বরাদ্দ করা হয়েছিল তা বিতরণ করা হয়নি। সরকারের নীতিকৌশল সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা না হলে এই দুর্যোগ থেকে বের হয়ে আসা কঠিন হবে।
নয়া দিগন্ত : রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির প্রেক্ষিতে নতুন অর্থবছরের বাজেট তৈরিতে সরকারকে কী কী পদক্ষেপ ও দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে বলে আপনার মনে হয়?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : আসন্ন বাজেটে গতানুগতিক বাজেট না করে বিশেষ বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বাজেট করতে হবে। আয় ব্যয়ের হিসাব, কত কর নেবে, কী পরিমাণ জিডিপির হার বাড়াবে, সেগুলো তো থাকবেই বাজেটে। এখন এই পরিস্থিতিতে যে সব কৌশল নেয়া দরকার তা নিতে হবে এবং সেই সব কৌশলের বাস্তবায়ন করতে হবে। মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। জনগণের সাথে আলোচনা করে কাজ করতে হবে। অন্যথায় জনগণের জন্য উন্নয়ন হবে না। দুর্যোগ থেকে বেরিয়ে আসাটা কঠিন হবে।
এ ছাড়া বাজেটে কয়েকটা সংস্কার করা দরকার। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতে এখনো বেশ দুর্বলতা আছে। এখানে কতগুলো যথেষ্ট শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। আরো সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হবে। কোভিড মোকাবেলায় তাদেরকে গতানুগতিক ধারার বাইরে আসতে হবে। আর এসবের প্রতি নজর রেখে আমাদেরকে স্বাস্থ্যসেবার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাপনা এখনো দুর্বল। এই সেবা এখনো সম্মিলিতভাবে হচ্ছে না। এখানে সমন্বয়ের অভাব আছে। এরপর হলো জীবিকা। বিশেষত ছোট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে অর্থায়ন।
নয়া দিগন্ত : সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা কতটা বাস্তব কার্যকর হয়েছে আপনি মনে করেন? ধাক্কা মোকাবেলায় বা সামাল দিতে কী করণীয় বলে মনে করেন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : দুঃখজনক হলো, ওসব ঠিকমতো বাস্তবায়ন হয়নি। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করছে অনেকটাই বিতরণ হয়েছে। তাৎক্ষণিক যা করতে হবে, যা বিতরণ হয়নি তা দ্রুত বিতরণ করতে হবে। বড়দের ঋণ দেয়াতে যতটা ঝুঁকি, এসএমইদের তার চেয়ে কম। ওদের আদায় ৯০ শতাংশ হয়। যতটা আদায় হবে না, সরকার বলবে আমরা বিশেষ পদক্ষেপ নিয়ে তোমাদের সেটা পূরণ করে দেব। ভর্তুকি দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে আরো সিলেক্টিভ হতে হবে। বিশেষ একটা খাতে গার্মেন্টে শুধু দিয়েই যাচ্ছে। ভর্তুকি কৃষিতে দিতেই হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের অহেতুক কিছু প্রকল্প আছে বছরের পর বছর সময় বাড়িয়ে চলছে। এসব শেষ করে দিয়ে ওই টাকা অন্যান্য খাতে দিতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় প্রকল্প ছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অহেতুক প্রকল্প না রাখা। এতে এডিপিতে খরচ কমবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে ছোট ও মাঝারি শিল্পকে সহায়তা দিতে হবে। কারণ কর্মসংস্থানের উৎস তো সেগুলোই। বড় শিল্পগুলোতে কর্মসংস্থান কম হয়।
নয়া দিগন্ত : ঘাটতি মোকাবেলায় বা সামাল দিতে কী করণীয় বলে মনে করেন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : আয়ের উৎস বাড়াতে হলে করের আওতা বা করনেট বাড়াতে হবে। কর হার বাড়ানো যাবে না। পাশাপাশি রাজস্ব বোর্ডের কর আদায়ের ব্যবস্থাকে আরো আধুনিকায়ন করতে হবে। কর সংগ্রহে হয়রানি কমাতে হবে।
নয়া দিগন্ত : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনিও ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন।


আরো সংবাদ



premium cement