২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্বাগত বাংলা নববর্ষ ১৪২৮

-

আজ পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। স্বাগত ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণের উৎসবের দিন। গতকাল সূর্যাস্তের সাথে সাথে মহাকালের গর্ভে চিরতরে হারিয়ে গেছে আরো একটি বছর। আজকের নতুন সূর্যোদয় ঘটেছে নতুন বছরের বার্তা নিয়ে। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হয়েছে নতুন বছর। এবারের পয়লা বৈশাখ ভিন্ন মাত্রায় উদযাপন হচ্ছে। করোনা মহামারীতে বৈশাখের শুরুর দিন যে উন্মাদনা থাকে এবারে তা হচ্ছে না। আজ থেকে শুরু হচ্ছে কঠোর লকডাউন। ঘরে থেকেই মানুষ পয়লা বৈশাখ উদযাপন করবে। খুবই সীমিত আকারে প্রতীকী দুয়েকটি কর্মসূচি থাকলেও রমনার বটমূল কিংবা ছায়ানটে কোনো কর্মসূচি থাকছে না। চারুকলা ইনস্টিটিউট এক শ’ জনকে নিয়ে একটি শোভাযাত্রা করবে। তবে রেডিও-টেলিভিশনে সাংস্কৃতিক কর্মসূচি থাকবে। বাংলা নববর্ষের শুরুতে হালখাতা একটি ঐতিহ্য। ব্যবসায়ীরা পুরনো খাতা বাদ দিয়ে হালনাগাদ করে নেন নতুন খাতা। করোনার প্রভাবে সেখানেও উদযাপনে ভিন্নতা থাকবে। আজ সরকারি ছুটির দিন। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন।
কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার শুরু হয় মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চান্দ্র সন ও ইংরেজি সৌর সনকে ভিত্তি করে প্রবর্তন হয় নতুন এই বাংলা সন। ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথম দিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সাথে বাংলা বর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সাথে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে।
পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পয়লা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দিয়েছে।
আবহমানকাল ধরেই চলছে বৈশাখ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। নববর্ষের প্রকৃত রূপটি দৃশ্যমান হয় গ্রামে। একসময় গ্রামবাংলায় চৈত্রসংক্রান্তি ছিল প্রধান উৎসব। বছরের শেষ দিনে তেতো খাবার খেয়ে শরীর শুদ্ধ করতেন কৃষাণ-কৃষাণীরা। নির্মল চিত্তে প্রস্তুত হতেন নতুন বছরে প্রবেশ করার জন্য। এখনো বৈশাখ বরণের অংশ হিসেবে বাড়িঘর ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করেন গৃহিণীরা। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন সবাই। গোসল সারেন। নতুন পোশাক পরেন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যান। ঘরে ঘরে সাধ্যমতো বিশেষ খাবার রান্না করা হয়। থাকে পিঠাপুলির আয়োজন।
বাংলা নববর্ষে ব্যবসায়ীদের হালখাতা রীতি এখনো এ দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির আমেজ নিয়ে উৎসবের পরিধির আরো বিস্তার ঘটিয়েছে। কৃষকসমাজ আজো অনুসরণ করছে বাংলা বর্ষপঞ্জি। এককালে কেবল গ্রামাঞ্চলেই পয়লা বৈশাখের উৎসবে মেতে উঠতো মানুষ। নানা অনুষ্ঠান, মেলা আর হালখাতা খোলার মাধ্যমে তখন করানো হতো মিষ্টিমুখ। এখন আধুনিক বাঙালি তাদের বাংলা নববর্ষকে সাজিয়ে তুলছে শহরে নগরে সর্বত্রই। নববর্ষ উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটির দিন। জাতীয় সংবাদপত্রগুলো বাংলা নববর্ষের বিশেষ দিক তুলে ধরে ক্রোড়পত্র বের করেছে। সরকারি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেল নববর্ষকে ঘিরে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে।
চৈত্রসংক্রান্তির মাধ্যমে পুরনো সনকে বিদায় জানিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হবে নতুন বছর। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি করোনা মহামারী থেকে সহসা মুক্তির প্রত্যাশা নিয়ে আজ দ্বিতীয়বারের মতো কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নতুন বছরকে বরণ করে নেবে। গত বছরও করোনার ছোবলে তছনছ বিশে^ নীরবেই বরণ করে নেয়া হয় বাংলা নতুন বছরকে। সে বছর জাতি আশা করেছিল এবার হয়তো পুরনো নিয়মেই উৎসবে বরণ হবে বাংলা সন। কিন্তু করোনা মহামারীর ভয়াবহ ছোবলে এবারো ঘরে বসেই বরণ করতে হচ্ছে নতুন বছরকে।
ঘাতক ভাইরাস কোভিড-১৯ সারা বিশ্বকে অস্থিতিশীল ও অস্থির করে তোলার কারণে শারীরিক উপস্থিতিতে রমনার বটমূলে থাকবে না ছায়ানটের বর্ষবরণ, চারুকলায় থাকবে না মঙ্গল শোভাযাত্রা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কারণে জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থের কথা চিন্তা করে রমনার বটমূল, টিএসসি, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, শিল্পকলা একাডেমি, হাতিরঝিল, বাংলা একাডেমিসহ উৎসবের রঙিন আঙ্গিনাগুলো ঢাকা থাকবে স্বাস্থ্যবিধির চাদরে। আর উদীচী, খেলাঘর, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, ছায়ানটসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোও গতবারের মতো এবারো উদযাপন থেকে নিজেদের বিরত রাখছে।
রাষ্ট্রপতির বাণী
বাসস জানায়, রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ বলেছেন, বাঙালির জীবনে বাংলা নববর্ষের আবেদন চিরন্তন ও সর্বজনীন। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে এক বাণীতে এ কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, পয়লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ ১৪২৮। বাঙালির এক আনন্দ-উজ্জ্বল মহামিলনের দিন। আনন্দঘন এ দিনে রাষ্ট্রপতি দেশে-বিদেশে বসবাসরত সব বাংলাদেশীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখে দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে এক বাণীতে দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পয়লা বৈশাখ বাঙালির সম্প্রীতির দিন, বাঙালির মহামিলনের দিন। এ দিন সমগ্র জাতি জেগে ওঠে নবপ্রাণে নব-অঙ্গীকারে। সারা বছরের দুঃখ-জরা, মলিনতা ও ব্যর্থতাকে ভুলে সবাইকে আজ নব-আনন্দে জেগে ওঠার উদাত্ত আহ্বান জানাই।’
করোনাভাইরাস সংক্রমণে বর্তমান বিশ্ব বিপর্যস্ত। সে কারণে গত বছরের মতো এ বছরও আমাদের সীমিতভাবে সবাইকে জনসমাগম এড়িয়ে বাংলা নববর্ষ ডিজিটাল পদ্ধতিতে ঘরে বসে উদযাপনের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
তথ্যমন্ত্রীর শুভেচ্ছাবার্তা : বাংলা নববর্ষ ১৪২৮ উপলক্ষে গণমাধ্যমকর্মীসহ দেশে ও বিদেশে বসবাসরত সব বাংলা ভাষাভাষীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। বাংলা নববর্ষবরণকে বাঙালির সার্বজনীন উৎসব হিসেবে বর্ণনা করে তথ্যমন্ত্রী গতকাল তার শুভেচ্ছা বার্তায় বলেন, পৃথিবীর সব ভাষাভিত্তিক জাতির নিজস্ব সার্বজনীন উৎসব-পার্বণ রয়েছে। চীনাদের ‘চীনা নববর্ষ’, ইরান থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত ‘নওরোজ’, ইংরেজি ভাষাভাষীদের ‘ইংরেজি নববর্ষ’, ঠিক তেমনই পয়লা বৈশাখ বাংলা ভাষাভাষীদের সার্বজনীন উৎসব।
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী প্রতিরোধযুদ্ধে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই তার সক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারি নির্দেশনা ও বিধি যথাযথভাবে অনুসরণের মাধ্যমে মহামারীর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে রাখা হোক নতুন বছরের অন্যতম অঙ্গীকার। তিনি আরো বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও ডিজিটাল বাংলাদেশের আশীর্বাদে অনলাইনে বর্ষবরণ হোক নিজস্ব সংস্কৃতি আর আনন্দের রূপকার।

 


আরো সংবাদ



premium cement