১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
বিনা গবেষকদের অভিমত

তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির বেশি হওয়ায় ধানের শীষে চিটা

-

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গরম হাওয়ায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের হাজারো কৃষকের গোলায় ধান ভরার স্বপ্ন গুড়েবালি হয়েছে। মাত্র পাঁচ মিনিটের ‘হিটশকে’ দিগন্তজুড়ে ধানের শীষ বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে গেছে। শত শত হেক্টর জমির ধান মুহূর্তেই চিটায় পরিণত হয়েছে। সবুজ ধানের এমন অবস্থা দেখে চাষিরা এখন দিশেহারা। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) ধান গবেষকরা বলছেন, পরাগায়নের সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়ায় ধানের শীষ চিটা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ময়মনসিংহের চাষিদের প্রধান ফসল হচ্ছে বোরো ধান। চলতি মৌসুমে ময়মনসিংহ জেলায় দুই লাখ ৬১ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়। বেশির ভাগ জমিতে ব্রি-২৯, ব্রি-২৯ ও হাইব্রিড ধানের চাষ করেন কৃষকরা। আবাদকৃত জমিতে এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল প্রায় সাত লাখ ৮৪ হাজার মেট্রিক টন চাল। গত ৪ এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল। দিগন্তজুড়ে ফসলের ক্ষেতে সবুজ ধানের শীষ বাতাসের আলতো হাওয়ায় দোল খেলছিল, যা প্রত্যেক কৃষকের প্রাণ ছুঁয়েছিল। মাত্র কয়েক দিন পরই সেই মাঠ থেকে সোনালী ধানের ফসল ঘরে তোলার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন চাষিরা। কিন্তু সেই দিনের কালো সন্ধ্যায় হঠাৎ করে গরম বাতাসের দমকা হাওয়ায় হাজারো কৃষকের স্বপ্ন মুহূর্তেই গুড়েবালি হয়ে যায়। পরদিন সকালে মাঠে গিয়ে ধানের শীষ বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে কৃষকের চোখ ছলছল হয়ে ওঠে। সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায়। ফসলের ক্ষেতে এমন দৃশ্য দেখে দিশেহারা হয়ে যায় হাজারো কৃষক। কৃষকরা জানান, এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি কখনো। এমন দৃশ্যও দেখেননি তারা। মাঠের পর মাঠজুড়ে ‘শীষ’ আছে কিন্তু ধান বলতে কিছুই নেই। আছে শুধু চিটা। এখন ধান কেটে কোনো লাভ নেই। ফলন না হলে কাঁচা ধান গাছ কেটে গরুকে খাওয়ানো ছাড়া উপায় নেই। মাঠের পর মাঠ কাটতে শ্রমিকের মজুরিও পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় হাজারো কৃষক ঋণগ্রস্ত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কিভাবে দিনযাপন করবেন, কিভাবে পরিবারের খাদ্যের সংস্থান করবেন এমন চিন্তায় অনেক কৃষক উদ্বিগ্ন। সরকার যদি সহায়তা না করে তা হলে অসংখ্য কৃষকের উদরপূর্তি করাই দুরূহ হয়ে পড়বে বলেও জানান কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো: মতিউজ্জামান জানান, জেলার চার হাজার ২০১ হেক্টর জমির বোরো ধান গরম হাওয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার ৬০৩ হেক্টর জমির ধানের শীষ চিটায় পরিণত হয়েছে। এতে প্রায় আট হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদন থেকে চাষিরা বঞ্চিত হয়েছেন। যার বর্তমান বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৭০ লক্ষাধিক টাকা। তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ধানের পরাগায়নের সময় রেণুগুলো গরম হাওয়ায় ঝড়ে পড়েছে অথবা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পরাগায়ন হয়নি। গবেষকরা মাঠপর্যায়ে কারণ অনুসন্ধানে মাঠ পরিদর্শন করছেন। যেসব জমির ধানের শীষ এখনো গজায়নি সেই জমিতে পানি রাখতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। একই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের একটি তালিকা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। তিনি আরো জানান, জেলার ১৩টি উপজেলাতেই গরম হাওয়ায় বোরো ধান আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ত্রিশালে দুই হাজার ২৮৬ হেক্টর, গফরগাঁওয়ে ৫০০ হেক্টর, ঈশ্বরগঞ্জে ২৫০ হেক্টর, গৌরীপুরে ১৬০ হেক্টর, নান্দাইলে ২৫০ হেক্টর, ফুলবাড়িয়ায় ২২০ হেক্টর, ভালুকায় ১৫০ হেক্টর, সদরে ৯৫ হেক্টর, মুক্তাগাছায় ১০৫ হেক্টর, ফুলপুরে ১০০ হেক্টর, তারাকান্দায় ৩০ হেক্টর, হালুয়াঘাটে ৪০ হেক্টর ও ধোবাউড়ায় ১৫ হেক্টর বোরো ধানের কমবেশি ক্ষতি হয়েছে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম জানান, সাম্প্রতিক সময়ে আবহাওয়া কিছুটা বৈরী। মার্চের ২য়-৩য় সপ্তাহ থেকে তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। প্রতিদিনই তাপমাত্রা দিনের বেলায় ৩৫ ডিগ্রির উপরে চলে যাচ্ছে। এই তাপমাত্রা ধানের জন্য খুবই খারাপ। বিশেষ করে ধানের যখন ফুল আসছে। যেসব ক্ষেতে ধানের ফুল আসছে বা ফুল আসার পর্যায়ে রয়েছে অথবা এক দিন বা দুই দিন আগে ফুল আসা শেষ হয়েছে। এটিকে বলা হয় ‘এনথিসিস পিরিয়ড’ অর্থাৎ ‘গর্ভধারণ’ পর্যায়ের সময়টা খুবই ঝুঁকিপুর্ণ। পরাগায়ণের সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে ‘ফার্টিলাইজেশন’ অর্থাৎ ‘নিষিক্ত’ হয় না। যদি এক দুই দিনের মধ্যে নিষিক্ত হয়েও থাকে তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় পরাগায়ন হবে না। এ সময় ঝড়ো হাওয়া বা গরম বাতাস অথবা ৩৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার বেশি হাওয়ায় ধানের শীষ শুকিয়ে চিটা হয়েছে বলে জানান তিনি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষকদের করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে এখন কিছুই করার নেই। ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন শুধু একটা উপায় আছে তা হলো, ফুল আসার আগে থেকেই জমিতে সেচ দিতে হবে। কমপক্ষে ৩-৪ ইঞ্চি পানি জমিতে ধরে রাখতে হবে। তবেই গরম হাওয়ায় কিছুটা ক্ষতি ঠেকানো সম্ভব হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement