২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

লকডাউনের প্রভাব নেই শনাক্ত বেড়েই চলেছে

-

লকডাউন কার্যকর করার পরও করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। একই সাথে অব্যাহত রয়েছে মৃত্যুর উচ্চহার। গতকাল দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের নতুন রেকর্ড হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন সাত হাজার ৬২৬ জন, যা এক দিনে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। এ সময়ে মারা গেছেন ৬৩ জন। গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
এর আগের দিন মঙ্গলবার দেশে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হয়। এ দিন ৬৬ জনের মৃত্যুর খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এর আগে গত বছরের ৩০ জুন সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল ৬৪ জন।
দেশে সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত শনাক্ত ছয় লাখ ৫৯ হাজার ২৭৮ জন। মোট মৃত্যু ৯ হাজার ৪৪৭ জন। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন তিন হাজার ২৫৬ জন। এখন পর্যন্ত সুস্থ পাঁচ লাখ ৬১ হাজার ৬৩৯ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয় ৩৪ হাজার ৬৬৮টি, অ্যান্টিজেন টেস্টসহ নমুনা পরীক্ষা করা হয় ৩৪ হাজার ৬৩০টি। এখন পর্যন্ত ৪৮ লাখ ৮২ হাজার ৫৬৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর আরো জানায়, শনাক্ত বিবেচনায় গত ২৪ ঘণ্টায় প্রতি ১০০ নমুনায় ২২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ এবং এখন পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত বিবেচনায় প্রতি ১০০ জনে সুস্থ হয়েছে ৮৫ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং মারা গেছেন এক দশমিক ৪৩ শতাংশ।
গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ৩৯ জন পুরুষ এবং নারী ২৪ জন। এখন পর্যন্ত পুরুষ সাত হাজার ৮২ জন এবং নারী মৃত্যুবরণ করেছেন দুই হাজার ৩৬৫ জন।
বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬০ বছরের ওপরে ৪০ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ১২ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে পাঁচজন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে দুইজন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে তিনজন এবং ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে একজন মারা গেছেন।
বিভাগ বিশ্লেষণে দেখা যায়, মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে মারা গেছেন ৪১ জন, চট্টগ্রামে ১০ জন, রাজশাহীতে চারজন, খুলনায় দুইজন, বরিশালে একজন, ময়মনসিংহে দুইজন এবং সিলেটে তিনজন। ২৪ ঘণ্টায় ৬৩ জনই হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন।
লকডাউন অকার্যকর হলে বিকল্প কী : বাংলাদেশে চলমান লকডাউন কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়লেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই এবং এটি কার্যকর করতে সরকার প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহায়তা নিতে পারে এবং জারি করতে পারে রাত্রিকালীন কারফিউ।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইতোমধ্যে সতর্ক করে বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে পুরো শহরকে হাসপাতাল বানালেও জায়গা দেয়া যাবে না। বুধবারও এক অনুষ্ঠানে করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় সরকারের নানা পদক্ষেপের বর্ণনা দিয়ে সংক্রমণ রোধের ওপরই জোর দিয়েছেন তিনি ।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমাদের চেষ্টা করে যাচ্ছি। সংক্রমণ রোধ করতে হবে। একটি হাসপাতাল তৈরি করছি; কিন্তু আমরা জানি এটাও অপ্রতুল হবে সংক্রমণ রোধ করতে না পারলে।’
করোনাভাইরাস সংক্রমণের গতি রোধের জন্যই গত ২৯ মার্চ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে ১৮ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। পরে গত সোমবার থেকে এক সপ্তাহের বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়, যা জনসাধারণের মাঝে লকডাউন হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো সেটি মাত্র দু’দিন পরেই ভেঙে পড়েছে এবং কর্তৃপক্ষ নিজেই শহরের মধ্যে বাস চালনার অনুমতি দিয়েছে। অর্থাৎ এক দিকে অকার্যকর হয়েছে লকডাউন, অন্য দিকে স্বাস্থ্যবিধি পালনের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির পরিচালক কাওসার আফসানা বলছেন, একটি কার্যকর লকডাউন ছাড়া সংক্রমণের গতিরোধের আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ‘পুলিশ বা আর্মি যাদের দিয়ে অন্য দেশে কন্ট্রোল করা হয়েছে, আমাদের দেশেও তা করতে হবে। দু’সপ্তাহ কঠোর লকডাউন করেন। লকডাউন মানে সব বন্ধ থাকবে। একটু আস্থা দিতে হবে যে, তুমি ঘরে থাকলে কী করব; কিন্তু লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই।’
কাওসার আফসানা বলছেন, যেকোনো ধরনের জমায়েত বন্ধে কঠোরতার পাশাপাশি লকডাউনে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের সরাসরি সহায়তা নিশ্চিত করে আগ্রহী করতে হবে।
আরেকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলছেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণের গতি ঠেকাতে লকডাউনই বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত উপায়। তিনি বলেন, উপর থেকে চাপিয়ে না দিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লকডাউন কার্যকর করার উপায় খুঁজতে হবে কর্তৃপক্ষকে। বাংলাদেশে গত বছর ২৫ মার্চ সরকার প্রাথমিকভাবে ১০ দিনের একটি লকডাউন ঘোষণা করেছিল, যা পরে কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছিল। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় জুনের পর লকডাউন শিথিল করে নেয়া হয়েছিল।
কিন্তু এবারের লকডাউন কার্যত ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে ব্যবসায়ীদের চাপ আর মানুষের দুর্ভোগ কমাতে যান চলাচলে অনুমতি দেয়ার কারণেই।
আবার জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অভিভাবকের জমায়েতের সুযোগ দেয়া কিংবা মেলা চালু রাখা ছাড়াও নানা জায়গায় নানা সমাবেশ করতে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবতার ভিত্তিতে কৌশল নিয়ে প্রয়োজনে রাত্রিকালীন কারফিউর কথাও বিবেচনা করতে পারে সরকার। তবে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর লকডাউনের জন্য সেনাবাহিনীর সহায়তা নেয়া বা রাত্রিকালীন কারফিউর প্রয়োজনীয়তা আছে কি না সে বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো মতামত পাওয়া যায়নি। তবে কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোকে ঘিরে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে এবং তার আলোকেই মঙ্গলবার মাদরাসাগুলো বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং বুধবারই ধর্মীয় উপাসনালয়েও গণজমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে বিবিসি বাংলা।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। গত একদিনে চট্টগ্রামে তিন মারা গেছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে আরো ৪১৪ জনের শরীরে করোনার জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। নতুন শনাক্তদের মধ্যে ৩৭৩ জন নগরীর ও ৪১ জন উপজেলার বাসিন্দা রয়েছে। গতকাল চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিন নারীর মৃত্যু হয়েছে। একদিনে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন আরো ৩৮ জন। এ পর্যন্ত উপজেলায় মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৯৯৫ জন। করোনাক্রান্ত উপজেলার আতলাশপুর এলাকার দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী জোসনা বেগম (৫০) এবং বরপা এলাকার বোরহান মোল্লার স্ত্রী খালেদা বেগম (৪৫) কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে মারা যান। এ ছাড়া মিলি আক্তার (৩৫) নামে এক নারী বরপা এলাকায় বাস করতেন। তার গ্রামের বাড়ি রংপুরে। তিনি রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে মারা যান।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহীতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরো দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। গত মঙ্গলবার তাদের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে রাজশাহী জেলায় করোনাভাইরাসে মোট ৫৯ জনের মৃত্যু হলো। গতকাল বুধবার রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভাগের আটটি জেলায় এ পর্যন্ত ৪১৮ জনের মৃত্যু হলো করোনায়। মঙ্গলবার বিভাগে নতুন ১৬০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন।
মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, মানিকগঞ্জে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, সাটুরিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও মানিকগঞ্জ জেলা কৃষকদলের সাধারণ সম্পাদকের মো: আব্দুস সোবহান (৭৫)।
এ দিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় মানিকগঞ্জে নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১১ জন। এ নিয়ে জেলায় মোট করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল দুই হাজার সাতজন।
সাতক্ষীরা সংবাদদাতা জানান, করোনায় আক্রান্ত হয়ে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে তিনি মারা যান। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ওই ব্যক্তির নাম মো: আব্দুল মজিদ (৫৭)। তিনি যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার মির্জাপুর দোস্তপুর এলাকার মৃত ওয়াজেদ আলীর ছেলে।
সোনারগাঁও (নারায়ণগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে নতুন করে আরো ২১ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। সুস্থ হয়েছে ছয় জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৩০.৩৯ শতাংশ। গতকাল বুধবার দুপুরে সোনারগাঁও উপজেলা পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: পলাশ কুমার সাহা এ তথ্য জানান।
উজিরপুর (বরিশাল) সংবাদদাতা জানান, সারা দেশে সরকারঘোষিত চলমান লকডাউনের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় বরিশালের উজিরপুরে যুবক ও বৃদ্ধাসহ নতুন করে আরো তিনজন আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে উপজেলায় মোট ২১৩ জন বাসিন্দা আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১৯২ জন এবং মারা গেছেন সাতজন।
নোয়াখালী অফিস জানায়, নোয়াখালী-৩ (বেগমগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য, গ্লোব গ্রুপ অব কোম্পানিজের এমডি মো: মামুনুর রশীদ কিরন এবং তার বড় ছেলে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি জিহান আল রশিদ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
জিহান আল রশিদ এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, গত কয়েক দিন অসুস্থ বোধ করায় গত সোমবার করোনা পরীক্ষার জন্য ঢাকার এভার কেয়ার হাসপাতালে বাবা-আমিসহ আমাদের পরিবারের চার সদস্য নমুনা দিই। পরে মঙ্গলবার বিকেলে আমার আর বাবার করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। তবে বর্তমানে আমাদের শারীরিক অবস্থা ভালো। এমপি কিরন ও তার ছেলের রোগমুক্তি কামনা করে দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছে তার পরিবার।
দিনাজপুর সংবাদদাতা জানান, দিনাজপুর জেলায় আরো ২৫ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। গতকাল বিকেলে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় এ তথ্য জানান। এর মধ্যে দিনাজপুর সদর উপজেলায় ১৯ জন, বিরলে একজন, বোচাগঞ্জে তিনজন, চিরিরবন্দরে এক ও পার্বতীপুর উপজেলায় একজন রয়েছেন।
টাঙ্গাইল সংবাদদাতা জানান, টাঙ্গাইলে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরো ৩৮ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে বুধবার সকাল পর্যন্ত জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেন চার হাজার ২১৫ জন। জেলায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৬৭ জন এবং সুস্থ হয়েছেন তিন হাজার ৮৫৪ জন।

 


আরো সংবাদ



premium cement