১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না গণপরিবহনে

লকডাউন প্রত্যাহারে বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ ; রাইড শেয়ারিংয়ের অনুমতি দাবি
-

করোনার সংক্রমণ রোধে এক সপ্তাহের লকডাউনের তৃতীয় দিন থেকে রাজধানীসহ দেশের সিটি করপোরেশন শহরগুলোতে বাস চলাচলের অনুমতি দিয়েছে সরকার। সে অনুযায়ী গতকাল সকাল ৬টা থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন রুটে বাস চলাচল শুরু করলেও কোনো পরিবহনে সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। এ দিকে গতকালও লকডাউন প্রত্যাহারের দাবিতে বুসন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স, ইস্টার্ন প্লাজা, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া ও বিমানবন্দর সড়কে বিক্ষোভ করেছেন বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখে গেছে, পুলিশ না থাকলেই খুলছে ছোট দোকান। তবে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখলেই বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর মিরপুর, বিজয়সরণি, ফার্মগেট, তেজগাঁও কাকরাইল, ধানমন্ডি, সায়েন্সল্যাব, প্রেস ক্লাব, পল্টন, মতিঝিল এলাকায় ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
গত মঙ্গলবার সরকারের পক্ষ থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সিটি করপোরেশন শহরে বাস চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। গতকাল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সকাল ৬টা থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন রুটে বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির বাস চলতে শুরু করে। ৬০ ভাগ বেশি ভাড়া নিয়ে বাস চালালেও কোথাও যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। যাত্রীদের মাঝে মাস্ক পরার প্রবণতা আগের থেকে বৃদ্ধি পেলেও বাসের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজাররা সেটাও মানছেন না। মাস্ক না পরে অথবা কানের সাথে ঝুলিয়ে হেলপাররা সেই আগের মতোই যাত্রীদের টেনে তুলছে। নামার সময় সামাজিক দূরত্ব দূরে থাক শরীরে হাত দিয়ে নামিয়ে দিচ্ছে। আগের মতোই চালকের আসনে থাকা ব্যক্তি মাস্ক ছাড়াই বসে আছেন। প্রয়োজনে বাসে বসেই সিগারেট টানছেন।
সব থেকে বড় কথা কোনো বাসেই স্যানিটাইজারের ব্যবহার চোখে পড়েনি। অথচ নিয়ম অনুযায়ী একজন যাত্রীকে বাসে তোলার আগে তার দুই হাত স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এরপর যাত্রী যে আসনে বসবেন সেটিও জীবাণুনাশক দিয়ে স্প্রে করতে হবে। ওই যাত্রী বাস থেকে নেমে যাওয়ার পর পুনরায় সিটে স্প্রে করতে হবে। অথচ রাজধানীতে চলাচলকারী কোনো বাসেই স্বাস্থ্যবিধি মানার এসব চিত্র চোখে পড়েনি।
এ দিকে গতকালও মার্কেট ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ব্যবসায়ী। গতকাল সকালে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি ও ইস্টার্ন প্লাজা শপিং কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া দোকান ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মার্কেট খুলে দেয়ার দাবিতে সকাল থেকেই ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা বিভিন্ন মার্কেটের সামনে সমবেত হতে থাকেন। এ সময় তারা ‘স্বাস্থ্যবিধি মানব, দোকানপাট খুলব ‘আমাদের দাবি মানতে হবে, দোকানপাট খুলতে হবে’ ‘গণপরিবহন যদি চলবে, মার্কেট কেন বন্ধ থাকবে’ ইত্যাদি নানা স্লেøাগান দিয়ে তাদের দাবি জানাতে থাকেন।
বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের সামনের সড়কে ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের বিক্ষোভের মুখে কিছু সময়ের জন্য যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবসায়ীদের রাস্তা থেকে সরে যেতে বলে। পরে ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা সুশৃঙ্খলভাবে মার্কেটের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। একইভাবে ইস্টার্ন প্লাজার সামনে ব্যবসায়ী-কর্মচারীরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। নিউমার্কেট, গাউছিয়া, এলিফেন্ট রোড, সায়েন্সল্যাবরেটরিসহ বিভিন্ন মার্কেটের সামনে অসংখ্য দোকান মালিক ও কর্মচারীকে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারা বলেন, সামনে রমজান, স্বাস্থ্যবিধি মেনে মার্কেট খুলে দেয়া হলে তারা বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবেন। গত বছর করোনাকালে এমনিতেই তারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা করোনা সংক্রমণ রোধে সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন বলে জানান।
এ দিকে চলমান লকডাউনে অন্যান্য যানের মতো অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেল পুনরায় চালুর করার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন রাইড শেয়ারিং মোটারসাইকেল চালকেরা। গতকাল রাজধানীর মগবাজার, বেইলি রোড, শ্যামলী, এয়ারপোর্ট ও তেজগাঁওয়ে সড়ক অবরোধ করে স্বল্প সময়ের জন্য বিক্ষোভ করে তারা। এর মধ্যে মগবাজারে প্রায় আধা ঘণ্টার বিক্ষোভে যান চলাচল ব্যাহত হয়।
বিক্ষোভকারী আরমান হোসেন বলেন, ‘লকডাউনের শুরু থেকেই বাস ও মোটরসাইকেল ছাড়া সব যানবাহন চলাচল করছে। গতকাল থেকে বাসও চালাচলে অনুমতি পেয়েছে। শুধু বাইকারদের নিয়েই কেন সমস্যা? একটা বাইকের পেছনে একজন মানুষ গেলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সরকারের নিয়মে সবাই চালাতে পারলে আমরা কেন পারব না। তিনি বলেন, আমরা দিনমজুরি। প্রতিদিনের আয় দিয়ে প্রতিদিনের সংসার চালাই। আমাদের কারো কাছে বসে থেকে কয়েক দিন খাবারের মতো সম্পদ নেই। এর মধ্যে আমার মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানদের ওষুধ কিনতে হয়। এটার ওপর নিষেধাজ্ঞা হলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগেই মারা যাব।’
উল্লেখ্য, করোনার সংক্রমণ রোধে সরকার গত ৫ এপ্রিল থেকে সারা দেশে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন জারি করে। এরই অংশ হিসেবে সারা দেশে গণপরিবহনসহ জরুরি সেবার বাইরে সব ধরনের পরিবহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিল্পকারখানা সীমিত আকারে চালু রেখে বন্ধ করা হয় অফিস-মার্কেট। যদিও এই বিধিনিষেধ আরোপের পর থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দোকান-মার্কেট খুলে দেয়ার দাবিতে বিক্ষোভসহ সড়ক অবরোধ করতে দেখা যায়। এরপর গত বুধবার থেকে সিটি করপোরেশন শহরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়।
রাজশাহীতে বিক্ষোভ
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, গতকাল বেলা ১১টার দিকে নগরীর সাহেববাজারে বিক্ষোভ করেন তারা।
এর আগে সকালেই তারা দোকান খোলেন। কিন্তু পরে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের জরিমানা করতে গেলে ব্যবসায়ীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা ঘোষণা দেন, কাউকে জরিমানা করা হলে আন্দোলন জোরদার হবে। ব্যবসায়ীরা রাস্তায় নেমে পড়ায় ম্যাজিস্ট্রেট কাউকে জরিমানা করেননি। ম্যাজিস্ট্রেট চলে যাওয়ার পরই ব্যবসায়ীরা দোকান খোলেন। তবে ক্রেতার সংখ্যা ছিল কম। দুপুর পর্যন্ত আর কেউ তাদের দোকান খোলার ব্যাপারে বাধা দেয়নি।
রাজশাহী বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি অশোককুমার সাংবাদিকদের জানান, শহরের আরডিএ মার্কেট, বিনোদপুর, কোর্টবাজারসহ অন্যান্য এলাকার সব দোকানপাট খোলা। তাই আমরাও সকাল থেকে একপাল্লা, দুইপাল্লা তুলে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। একটু পর ম্যাজিস্ট্রেট আসেন। তিনি জরিমানা করতে শুরু করেন। আমরা তাকে বোঝালাম যে, করোনায় আমরাও নাজেহাল, ধারদেনা করে মাল তুলেছি। করোনার ভেতর ব্যবসা খারাপ। হঠাৎ লকডাউন আসবে বুঝতেও পারিনি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা ব্যবসা করতে চাই। তারপর ম্যাজিস্ট্রেট চলে গেছেন। আমরাও অর্ধেক শাটার তুলে ব্যবসা করছি। কিন্তু ক্রেতা কম।
বগুড়ায় বিক্ষোভ
বগুড়া অফিস জানায়, গত দুই দিনের চেয়ে লকডাউনের তৃতীয় দিনে শহরে মানুষের ভিড় আরো বেশি ছিল। সকাল থেকেই শহরে ছিল তীব্র যানজট। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যক্তিগত পরিবহন, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, অটোরিকশা চলাচল করেছে।
বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে দোকান খুলে দেয়ার দাবিতে মানববন্ধন ও মিছিল সমাবেশ হয়েছে। এতে শহরের নিউমার্কেট, শেখ শরীফ উদ্দিন সুপার মার্কেট, টিএমএসএস মোবাইল মার্কেট, আল আমিন শপিং সেন্টার, রানা প্লাজার ব্যবসায়ীরা অংশগ্রহণ করেন। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন ব্যবসায়ী নেতা শামীম সরকার, শিবলু আলী সরদার, সিরাজুল ইসলাম রতন, শাহীন মণ্ডল, মামুন হোসেন, রেজাউল করিম, সোহেল, আব্দুর রশিদ, শেখর, লুৎফর রহমান, শাহীন প্রমুখ। এতে বক্তারা বলেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার বিকল্প নেই।
গাজীপুরে মানববন্ধন
গাজীপুর মহানগর সংবাদদাতা জানান, লকডাউনে দোকানপাট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখার দাবিতে মানববন্ধন করেছেন গাজীপুর মহানগরের ব্যবসায়ীরা। গাজীপুর মহানগরের ব্যবসাবাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার ব্যবসায়ীরা ‘স্বাস্থ্য বিধি মানব, দোকান পাঠ খুলব’ এ সেøাগানে বুধবার মানববন্ধন করেন। অপর দিকে টঙ্গী, উত্তরা ও আশপাশের এলাকার ব্যবসাবাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ঐতিহাসিক টঙ্গীবাজার এলাকার শত শত ব্যবসায়ী ও তাদের কর্মচারীরাও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে পৃথক মানববন্ধন করেছেন।
ব্যবসায়ীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দোকান ও শপিং মলগুলো খোলা রাখার দাবি জানিয়ে বক্তৃতায় বলেন, ব্যবসা পরিচালনায় ব্যাংক ঋণ, এনজিও ঋণ, দোকান ভাড়া, সিকিউরিটি, বাসা ভাড়া, কর্মচারীদের বেতনসহ পরিবারের অন্যান্য ব্যয়ভার মেটানোর সক্ষমতা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। গত বছর প্রথম দফার লকডাউন থেকে এখন পর্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছি। বছরে সব চেয়ে বেশি বেচাকেনা হয় ঈদকে ঘিরে। আর এই সময় যদি দোকান খুলতে না পারি তাহলে আমাদের পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
মানববন্ধনে বক্তব্য দেন ব্যবসায়ী নেতা শরিফুল ইসলাম, হাজী আব্দুর রশিদ, আবুল হোসেন, সেলিম মাহমুদ, মনির হোসেন, জাকির হোসেন, কাউছার আলম প্রমুখ।
অপর দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গীবাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে ব্যবসায়ীরা স্বল্প পরিসরে হলেও বেঁচে থাকার স্বার্থে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার জোর দাবি জানান।
সাভারে মহাসড়ক অবরোধ
সাভার (ঢাকা) সংবাদদাতা জানান, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাসস্ট্যান্ডের সাভার নিউমার্কেটের সামনে সাভারের সর্বস্তরের ব্যবসায়ীর ব্যানারে মহাসড়ক অবরোধ করে মানববন্ধন করা হয়। এ সময় মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা সব মার্কেটের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ একত্রে বসে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মসূচি পালন করবে জানিয়ে মহাসড়ক থেকে সবাই সরে গেলে গণপরিবহনসহ সব ধরনের যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
আন্দোলনরত তরুণ ব্যবসায়ী ইয়াসিন জানান, গত বছরও করোনার কারণে লকডাউন ছিল, সে জন্য মার্কেট বন্ধ ছিল। এ বছরও সামনে রমজান মাস এবং ঈদুল ফিতর। আমরা যারা ব্যবসায়ী ঈদ সামনে রেখে মালামাল দোকানে উঠিয়েছি, লকডাউনের কারণে এ বছরও বড় ধরনের লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছি। এ সময় তিনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে মার্কেট খুলে দেয়ার দাবি জানান।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল