২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইসির বিরোধ রূপ নিয়েছে বিতণ্ডায়

‘নির্বাচন কমিশনকে হেয় করতে যা করা দরকার সবই করছেন মাহবুব তালুকদার’; ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন চললে কমিশনের প্রয়োজন হবে কি না সেটাই বড় প্রশ্ন’
-

নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরীণ বিরোধ এখন বিতণ্ডায় রূপ নিয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিমনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা এবং সিনিয়র নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার অনেক দিন ধরেই নানা ইস্যুতে ভিন্ন মত পোষণ করে আসছিলেন। কমিশনের বৈঠকে নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুতে সিইসি এবং অন্য কয়েকজন কমিশনারের সাথে একমত হতে পারছিলেন না মাহবুব কমিশনার। তিনি নানা ইস্যুতে নোট অব ডিসেন্ট জানিয়ে সভা বর্জন করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। গতকাল ভোটার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মাহবুব তালুকদারের ভিন্ন ধারার বক্তব্য নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সিইসি নুরুল হুদা।
গতকাল ভোটার দিবসের অনুষ্ঠানে সিইসি বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে হেয়, অপদস্ত করার জন্য নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার যা করা দরকার সবই করছেন। তিনি এও বলেন যে, ব্যক্তিগত স্বার্থে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কমিশনকে হেয় করে চলেছেন মাহবুব তালুকদার। তিনি সবসময় ইসিতে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন। সব কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করছেন। এগুলো উনি ঠিক করছেন না। তবে আমরা কখনো বাধা দেইনি। কারণ সংবিধানের ১৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। এর আগে চট্টগ্রামের রাউজান পৌরসভা নির্বাচনের উদাহরণ টেনে সিনিয়র নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে চমক সৃষ্টিকারী পৌরসভা নির্বাচন হয়েছে চট্টগ্রামের রাউজানে। ২৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে এখানে মেয়র ও ১২ জন কাউন্সিলর বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে রাউজান থেকে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও তখন তুলে নেয়া হয়েছে। ইতঃপূর্বে উপজেলা নির্বাচনেও ঠিক এভাবেই রাউজানে সবাই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে এটা ‘নির্বাচন’ না বলে ‘মনোনয়ন’ বলাই সম্ভবত অধিকতর সঙ্গত।
তিনি বলেন, সারা দেশে যদি চট্টগ্রামের রাউজান মডেলে সবাই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি হতে পারেন, তাহলে নির্বাচনে অনেক আর্থিক সাশ্রয় হয় এবং সহিংসতা ও হানাহানি থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এতে নির্বাচন কমিশনের দায়-দায়িত্ব তেমন থাকবে না। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের আর প্রয়োজন হবে কি না, সেটা এক বড় প্রশ্ন।
আগারগাঁওস্থ নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে গতকাল জাতীয় ভোটার দিবস উপলক্ষে নির্বাচন কমিশন আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সিইসি ও ইসি মাহবুব এসব কথা বলেন। এই আলোচনা সভায় সিইসি প্রধান অতিথি আর মাহবুব তালুকদার বিশেষ অতিথি হিসেবে লিখিত বক্তব্য পেশ করেন। ইসি সচিব মো: হুমায়ুন কবীর খোন্দকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) শাহাদাত হোসেন চৌধুরীও বক্তব্য দেন।
মাহবুব তালুকদারের প্রসঙ্গে নুরুল হুদা বলেন, মাহবুব তালুকদার আমাদের এ নির্বাচনে যোগ দেয়ার পরদিন থেকে যা কিছু ইসির নেগেটিভ দিক তা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে অভ্যাসগতভাবে সব সময় পাঠ করতেন। আজো এর ব্যতিক্রম হয়নি। ভোটার দিবস উপলক্ষে তিনি (মাহবুব তালুকদার) একটা রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন। দেশের নির্বাচন কমিশনের স্বার্থে তিনি (মাহবুব তালুকদার) কাজ করেন না। ব্যক্তি স্বার্থে ও একটা উদ্দেশ্য সাধনে, এ কমিশনকে অপদস্ত করার জন্য যতটুকু যা করা দরকার তিনি ততটুকু করেছেন।
সিইসি বলেন, নির্বাচন কমিশনে তিনি যোগদান করার পর যতগুলো সভা হয়েছে সব সময় এটা করতেন। কমিশনের সামনে একটা বছর আছে এভাবে তিনি বলতে থাকবেন। তবে ভেবেছিলাম ভোটার দিবস হিসেবে তিনি (মাহবুব তালুকদার) কিছু বলবেন, কিন্তু তিনি রাজনৈতিক বক্তব্যই রাখলেন। ইসিকে কতখানি হেয় করা যায়, কতখানি নিচে নামানো যায়, অপদস্ত করা যায় তা তিনি করে চলেছেন।
সিইসি বলেন, গত চার বছর ধরে মাহবুব তালুকদার একই কাজ করছেন। তিনি সবসময় পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে নির্বাচন কমিশনের সমালোচনামূলক বক্তব্য রাখেন। পরদিন সেসব বক্তব্য কোনো কোনো পত্রিকায় আসছে, সেগুলোর কাটিং নিয়ে তিনি সবাইকে দেখিয়ে বেড়ান। সিইসি বলেন, কোনো কোনো কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ভোট কাস্ট হয়েছে। কিন্তু উনি ওইগুলো চোখে দেখেন না। উনি খুঁজে খুঁজে বের করেন কোথায় কম ভোট কাস্ট হয়েছে সেগুলো।
এর আগে মাহবুব তালুকদার তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, এককেন্দ্রিক স্থানীয় নির্বাচনের তেমন গুরুত্ব নেই। নির্বাচনে মনোনয়ন লাভই এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় নির্বাচনেও হানাহানি, মারামারি, কেন্দ্র দখল, ইভিএম ভাঙচুর ইত্যাদি মিলে এখন একটা অনিয়মের মডেল তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা হলেও অসংখ্য বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা দুর্ঘটনা মিলে এক ধরনের অবিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, যা নির্বাচনের অনুষঙ্গ হিসেবে রূপ লাভ করে।
সিনিয়র কমিশনার বলেন, ভোটার হওয়ার মধ্য দিয়ে একজন নাগরিক গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে ‘কার্যকর অংশগ্রহণ’ বলতে একজন যোগ্য জনপ্রতিনিধি বেছে নেয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যোগ্য জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তিনি নিজের বিবেকবোধের দ্বারা উদ্দীপ্ত হবেন। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, এমনকি গোষ্ঠীগত লাভালাভের বৃত্ত থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, এ কথা ধ্রুব সত্য যে, নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রে উত্তরণের একমাত্র পথ। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশীদারমূলক ও গ্রহণযোগ্য না হলে ক্ষমতার হস্তান্তর স্বাভাবিক হতে পারে না। নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হলে দেশের স্থিতিশীলতা, সামাজিক অস্থিরতা ও ব্যক্তির নৈরাশ্য বৃদ্ধি পায়। এর ফলে নৈরাশ্য থেকে নৈরাজ্য সৃষ্টি হওয়ায় আশঙ্কা রয়েছে। নৈরাজ্য প্রবণতা কোনো গণতান্ত্রিক দেশের জন্য মোটেই কাম্য নয়।
তিনি বলেন, দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সক্ষা রূপদানের জন্য নির্বাচন কমিশনের ওপর সাংবিধানিক দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে না পারলে আমরা গণতন্ত্র অস্তাচলে পাঠানোর দায়ে অভিযুক্ত হবো।
ইভিএম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এক সময়ে আমি বিভিন্ন কারণে ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের বিরোধী ছিলাম। বিশেষভাবে কোনো প্রস্তুতি ব্যতিরেকে ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে আপত্তি করেছি। বর্তমানে প্রধানত দু’টি কারণে আমি ইভিএমে ভোটগ্রহণে আগ্রহী। প্রথমত, ইভিএম এ ভোট হলে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণ সম্ভব হয় না। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন কেন্দ্রে শতভাগ ভোট কাস্ট হওয়ার বিড়ম্বনা থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ২১৩টি কেন্দ্রের ফলাফলে আমরা যা দেখেছি। তবে ইভিএম এ ভোট হলে ভোটারের উপস্থিতি ও ভোটের পরিসংখ্যান আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। বিগত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ভোটের শতকরা হার ছিল যথাক্রমে ২৫.৩৪ শতাংশ ও ২৯.০৭ শতাংশ। সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়েছে শতকরা সাড়ে ২২ ভাগ মাত্র। এত কম ভোটে আমরা রাজধানী ঢাকার দু’জন ও চট্টগ্রামের একজন নগরপিতাকে নির্বাচিত করেছি, যার নজির নিতান্ত বিরল।
তিনি বলেন, ইভিএম ব্যবহার করে আমরা সর্বত্র ভোট জালিয়াতি, কারচুপি, কেন্দ্র দখল ইত্যাদি অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছি। এমন দাবি আমি অন্তত করি না। কিন্তু ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো নিরসন করার উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। নির্বাচন বিষয়ক অনিয়ম ও অভিযোগ যথাযথভাবে আমলে না নেয়ায় আমরা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারি। তবে ভবিষ্যতে ব্যালট ও ইভিএম উভয় পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ একই নির্বাচনে দু’টি পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে ভোটপ্রদানের শতকরা হারের অনেক তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। এই পার্থক্যের অর্থ ভোটগ্রহণের ফলাফলে বিভেদ সৃষ্টি। ভোটগ্রহণে এ ধরনের বৈষম্য কাম্য নয়।
ইসি কমিশনার বলেন, আমি মনে করি, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার না হলে সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। আজো এই কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাই। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সংস্কার না হলে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সংশ্লিষ্ট সব মহলের ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার না হলে এখন যে ধরনের নির্বাচন হচ্ছে, তার মান আরো নিম্নগামী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement