২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সৌদি যুবরাজের নির্দেশে সাংবাদিক খাশোগি হত্যা

মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন
-

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নির্বাসিত অনুসন্ধানী সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার অভিযানে অনুমোদন দিয়েছিলেন বলে মার্কিন এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় শুক্রবার বাইডেনের প্রশাসন এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে গিয়ে খাশোগিকে ‘ধরতে বা খুন’ করতে যে অভিযান চালানো হয়েছিল, যুবরাজ মোহাম্মদ ওই পরিকল্পনার অনুমোদন দেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন সৌদি নাগরিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও যুবরাজের ওপর এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। অন্য দিকে সৌদি আরব এ প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে যে এটি ‘নেতিবাচক, মিথ্যা ও অগ্রহণযোগ্য’। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ, যিনি কার্যত দেশটির শাসক, তিনিও এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে তার জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
খাশোগি যখন তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনসুলেটে গিয়ে ছিলেন, তখনই তাকে হত্যা করে তার দেহ খণ্ড-বিখণ্ড করা হয়। ৫৯ বছর বয়সী এই সাংবাদিক একসময় সৌদি সরকারের উপদেষ্টা ও রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তবে একপর্যায়ে তিনি সব আনুকূল্য হারান এবং ২০১৭ সালে নিজেই যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে চলে যান। সেখান থেকে তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে একটি মাসিক কলাম লিখতেন, যেখানে তিনি যুবরাজ মোহাম্মদের নীতির সমালোচনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক অ্যাভ্রিল হেইনস শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেন, গোয়েন্দা সম্প্রদায়ের সাথে সমন্বয় করে এবং আইসির সূত্র ও পদ্ধতিগুলো রক্ষা করে এ প্রতিবেদনটিতে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে যা আছে : যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্সের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ‘আমরা ধারণা করছি সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ইস্তাম্বুলে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে গ্রেফতার বা হত্যার জন্য একটি অভিযানের অনুমোদন দিয়েছিলেন’। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ হলেন সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের ছেলে এবং দেশটির বর্তমান শাসক।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনটিতে এমন ধারণার পেছনে তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়, যাতে এটি পরিষ্কার যে প্রিন্স মোহাম্মদই ওই অভিযানের অনুমোদন দেন। ২০১৭ সাল থেকে সৌদি আরবের সব সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার একক নিয়ন্ত্রণ। ওই অভিযানে প্রিন্স মোহাম্মদের একজন উপদেষ্টা, সেই সাথে তার প্রতিরক্ষা দলের সদস্যের সরাসরি সম্পৃক্ত থাকা এবং বিদেশে নির্বাসনে থাকা ব্যক্তিদের মুখবন্ধ রাখতে সহিংস পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষে প্রিন্স মোহাম্মদের সমর্থন দেয়া। এই প্রতিবেদনে খাশোগি হত্যার সাথে জড়িত বা দায়ী ব্যক্তিদের নাম দেয়া হয়েছে। তবে এতে বলা হয়েছে, পরিকল্পনায় আর কারা কারা শামিল ছিল, সেটি এখনো আমরা পুরোপুরি জানি না।
সৌদি কর্তৃপক্ষ এই হত্যার পেছনে একদল এজেন্টকে দোষারোপ করছে, যারা বিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছিল। এ ছাড়া সৌদি আদালত প্রাথমিকভাবে পাঁচ ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিলেও গত সেপ্টেম্বরে বিচারক সেই সাজা কমিয়ে প্রত্যেককে ২০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।
২০১৯ সালে জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত অ্যাগনেস ক্যালামার্ডের অভিযোগ, সৌদি আরব ইচ্ছাকৃতভাবে এবং আগে থেকে পরিকল্পনা করেই খাশোগিকে হত্যা করেছে। সেই সাথে এ ঘটনায় সৌদি আরবের আদালত যে রায় দিয়েছে তা ‘ন্যায়বিচারের পরিপন্থী’ উল্লেখ করে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
দুই দেশের সম্পর্কে এ ঘটনা কী বার্তা দেয়? : এই প্রতিবেদন প্রকাশের অল্প সময়ের মধ্যেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন কয়েকজন সৌদি নাগরিকের উদ্দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন। যাকে ‘খাশোগি ব্যান’ বলা হয়। ব্লিংকেন বলেন, ‘যাদেরকে উদ্দেশ করে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তারা নিজ দেশের বাইরেও ভিন্নমত দমনে ভয়াবহ সব কার্যকলাপের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত।’ এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগও ক্রাউন প্রিন্সের আশপাশের কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর মধ্যে রয়েছেÑ তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী, সাবেক উপ গোয়েন্দা প্রধান আহমাদ আসিরি, সেই সাথে তার ব্যক্তিগত সুরক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী, যারা হত্যার সাথে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১৮ সালে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ধারণা করেছিল যে ক্রাউন প্রিন্সই এ হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। তবে তিনি যে জড়িত ছিলেন সে অভিযোগ মার্কিন কর্মকর্তারা এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে বলেননি।
বিশ্বের বৃহত্তম তেল রফতানিকারী দেশ সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রধান মিত্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি আরবের মানবাধিকার ও আইনের শাসনের বিষয়ে তার পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে দৃঢ় অবস্থান নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার বাদশাহ সালমানের সাথে ফোনালাপ করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। ‘যুক্তরাষ্ট্র যে সার্বজনীন মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে’Ñ বাইডেন সে বিষয়টি ফোনালাপে নিশ্চিত করেছেন বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউজ।
বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, সৌদি আরবের সাথে অস্ত্র চুক্তি বাতিল করার বিষয়েও বাইডেন প্রশাসন চিন্তাভাবনা করছে। কারণ এ চুক্তি মানবাধিকারকে উদ্বেগের মুখে ফেলেছে। ভবিষ্যতে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রয় শুধু ‘প্রতিরক্ষামূলক’ অস্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়টিও বিবেচনা করছে বাইডেন প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জোর দিয়ে বলেছে যে, এ অপরাধের পেছনে দায়ীদের খুঁজে বের করতে যথাযথভাবে তদন্ত করা হয়েছে এবং ন্যায়বিচারের করা হয়েছে। এটি সত্যিই দুঃখজনক যে এই প্রতিবেদনটি যেসব তথ্য দিয়েছে সব অযৌক্তিক ও ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
‘এবং এই ত্রুটিপূর্ণ প্রতিবেদনটি এমন সময় প্রকাশ করা হলো যখন সৌদি আরব এ জঘন্য অপরাধের স্পষ্ট নিন্দা জানিয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।’ সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, দেশটির নেতৃত্ব, সার্বভৌমত্ব ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করে এমন সব পদক্ষেপও তারা প্রত্যাখ্যান করছে।
এ দিকে এ ঘটনায় মোহাম্মদ বিন সালমান সাধারণ মানুষের রোষানলে পড়লেও তিনি মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে পার পেয়ে গেছেন। যদিও তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি, জাতিসঙ্ঘের বিশেষ রিপোর্টার অ্যাগনেস ক্যালামার্ডসহ বহু অ্যাকটিভিস্ট আহ্বান জানিয়েছিল।
এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন খুব সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তিনি তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সৌদি আরবকে যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী করতে চান, তেমনি আবার সৌদি আরবের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চান। কারণ মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে সৌদি আরব বেশ বড় ভূমিকায় আছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমন : ইয়েমেনের যুদ্ধ শেষ করা, ইরানকে আবার পরমাণু চুক্তিতে যুক্ত করা, উগ্রবাদী বিরুদ্ধে লড়াই এবং আরব-ইসরাইলি সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়া। তবে প্রেসিডেন্ট স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি তার পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো যুবরাজ মোহাম্মদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করবেন না। এর পরিবর্তে বাইডেন তার বাবা বাদশাহ সালমানের সাথে কাজ করছেন।
খাশোগিকে যেভাবে হত্যা করা হয় : খাশোগি তার তুর্কি বাগদত্তাকে বিয়ে করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে ২০১৮ সালের অক্টোবরে তুরস্কের সৌদি কনসুলেটে যান। ক্রাউন প্রিন্সের ভাই প্রিন্স খালিদ বিন সালমানের কাছ থেকে তিনি এই আশ্বাস পান যে, কনসুলেটে যাওয়াটা তার জন্য নিরাপদ হবে। সে সময় প্রিন্স খালিদ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। যদিও প্রিন্স খালিদ ওই সাংবাদিকের সাথে তার যোগাযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
সৌদি আইনপ্রণেতাদের মতে, খাশোগি আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে তার সাথে খুনিদের ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে তারা জোর করে খাশোগির শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রচুর ওষুধ দেয়। অতিরিক্ত মাত্রার ওষুধের ফলে খাশোগি সেখানেই মারা যান। এরপর তার দেহটি খণ্ড-বিখণ্ড করা হয় এবং ওই সব টুকরো কনসুলেটের বাইরে থাকা স্থানীয় একটি সহযোগীর কাছে দেয়া হয়, আইনপ্রণেতারা বলেছেন।
খাশোগির দেহাবশেষ কখনো পাওয়া যায়নি। তুরস্কের গোয়েন্দা বিভাগ হত্যাকাণ্ডের অডিও রেকর্ডিংটি সামনে আনার পর সেটির লিখিত প্রতিবেদনে বিশদ বিবরণ প্রকাশ পায়।
৭৬ সৌদি নাগরিকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা : জামাল খাশোগি হত্যার জেরে সৌদি আরবের সাবেক এক কর্মকর্তা ও রাজকীয় একটি বাহিনীর ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি দেশটির ৭৬ নাগরিকের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ঘোষিত এক নতুন নিষেধাজ্ঞা নীতির আওতায় পড়েছেন তারা। শুক্রবারের গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ‘খাশোগি নিষেধাজ্ঞা’ জারির ঘোষণা দেন। ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় তারাই পড়বেন যারা বিভিন্ন দেশের সরকারের হয়ে ভিন্ন মতাবলম্বী দমনে মারাত্মক এবং বিচারবর্হিভূত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকবেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement
টি-২০ খেলতে সিলেটে পৌঁছেছে ভারতীয় নারী ক্রিকেট দল খুলনায় হিটস্ট্রোকে এক ব্যক্তির মৃত্যু ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কী বলল যুক্তরাষ্ট্র? জিম্বাবুয়ে সিরিজের জন্য বাংলাদেশের প্রাথমিক দল ঘোষণা বৃষ্টির জন্য রাজশাহীতে ইসতিসকার নামাজ আদায় গাজীপুরে মহাসড়কের পাশ থেকে মৃত হাতি উদ্ধার প্রচণ্ড গরমের মধ্যে লোডশেডিং ১০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা : প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের গুলির নিন্দা জামায়াতের রাজধানীতে তৃষ্ণার্তদের মাঝে শিবিরের বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ রাজশাহীতে সাড়ে ৬ কোটি টাকার হেরোইনসহ যুবক গ্রেফতার এফডিসিতে সাংবাদিকদের ওপর হামলা

সকল