২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়েছেন হাইকোর্ট

পিপলস লিজিংয়ের ২৮০ ঋণখেলাপিকে তলব; পি কে হালদারের সহযোগী ও মেয়ে রিমান্ডে
-

দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে থাকা প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা উদঘাটনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থ কর্মকর্তাদের নামের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট। অর্থ পাচার রোধ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তদারক-নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগে গত এক যুগে কোন কোন কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের নাম, পদবি, ঠিকানাসহ বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন আদালত। অর্থপাচার রোধে সংশ্লিষ্ট বিভাগের এসব কর্মকর্তার ব্যর্থতা আছে কি না, ব্যর্থ হয়ে থাকলে কেন হলেন, অর্থপাচারের বিষয়টি তারা টের পেয়েছিলেন কি না, পেয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন কি না, তাদের ইন্ধন বা যোগসাজশে অর্থপাচার হয়েছে কি না, তা-ও জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বাংলাদেশ ব্যাংককে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে।
এ দিকে বাংলানিউজ জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগে ২০০৮ থেকে ২০২০ সালে দায়িত্বে থাকাদের নাম, পদবি, ঠিকানাসহ বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। বিদেশে পালিয়ে থাকা পি কে হালদারের বিষয়ে জারি করা রুল শুনানিতে গতকাল বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন বিচারপতি মো: নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
ওই সময়ে অর্থপাচার রোধে এসব কর্মকর্তার ব্যর্থতা আছে কি না এবং অর্থপাচারের বিষয়টি তারা টের পেয়েছিলেন কি না, পেয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন কি না তা আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে।
আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো: খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ।
গত ১৮ নভেম্বর একটি দৈনিকে ‘পি কে হালদারকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাইবে দুদক’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে নিয়ে গত ১৯ নভেম্বর তাকে বিদেশ থেকে ফেরাতে এবং গ্রেফতার করতে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে স্বপ্রণোদিত আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সেই আদেশের ধারাবাহিকতায় গতকাল এ আদেশ দেন আদালত।
গতকাল বিচারপতি মো: নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। একইসাথে এ মামলায় পক্ষভুক্ত হতে পিপলস লিজিংয়ের সাময়িক অবসায়ক (প্রবেশনাল লিক্যুডেটর) মো: আসাদুজ্জামান খানের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত।
ঋণখেলাপি ২৮০ জনকে হাইকোর্টে তলব : অপর দিকে পি কে হালদারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস থেকে পাঁচ লাখ টাকার বেশি টাকা ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপি হয়েছেন এমন ২৮০ জনকে তলব করেছেন হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ। গতকাল বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের নেতৃত্বাধীন একক হাইকোর্ট বেঞ্চ অবসায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা পিপলস লিজিংয়ের সাময়িক অবাসায়ক (প্রবেশনাল লিক্যুডেটর) মো: আসাদুজ্জামান খানের দেয়া তালিকা দেখে এ আদেশ দেন।
আদালতে কোম্পানির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার মেজবাহুর রহমান। তিনি বলেন, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড কোম্পানি অবসায়ন প্রসিডিংয়ের মধ্যে আছে। আদালত এ কোম্পানি থেকে ঋণগ্রহীতাদের তালিকা চেয়েছিলেন। আমরা সে তালিকা দিয়েছিলাম। সেই তালিকা থেকে সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ঋণখেলাপি এমন ২৮০ জনকে শোকজ করেছেন আদালত। আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি তাদেরকে আদালতে হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন হাইকোর্ট বেঞ্চ।
আদালত আদেশে বলেছেন, ২০০৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনটি বিভাগের কর্মকর্তারা কেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুটপাট ও অর্থ পাচারের বিষয়টি উদঘাটনে ব্যর্থ হলো, তা আমাদের জানতে হবে। দায়িত্বে থেকে কাজ করবে না, সেটার সুযোগ নেই।
বৃহস্পতিবার শুনানিতে আদালত বলেন, আমাদের দেখার বিষয় হলো তাদের ব্যর্থতা কেন? কেন তারা ব্যর্থ হলো, তারা কেন চিহ্নিত করতে পারল না? তাদের কোনো ইন্ধন ছিল কি না? যোগসাজশ আছে কি না? আমরা সেটা জানতে চাই। তারা ওই খানে চাকরি করবে, এত বড় একটা ঘটনা ঘটে যাবে, তারা কিছুই বলতে পারবে না। এটা তো হতে পারে না। তাদের অবশ্যই দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে। তারা পাবলিক সার্ভেন্টস। মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধ থাকতে হবে। কাজ করবেন কিছুই করতে-বলতে পারবেন না, খেয়ে দেয়ে বাড়ি বানাবেন, বেতনভাতা নেবেন, দেশের জন্য, জনগণের জন্য কাজ করবেন না, তা তো হয় না।
বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো: নজরুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে দুর্নীত দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মো: খুরশীদ আলম খান। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, পি কে হালদারের ৮৩ সহযোগীর নাম-পরিচয়সহ একটি প্রতিবেদন সারসংক্ষেপ আকারে আদালতে উপস্থাপন করেছি। আমরা পুরো রিপোর্ট দিতে পারেনি। সংক্ষেপে যেটা বলা হয়েছে তা হলো, এক হাজার ৫৬ কোটি টাকা জব্দ করা হয়েছে এবং এই ৮৩ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। তা ছাড়া আর্থিক খাতের দুর্নীতি নিয়ে আরো ১০টি মামলার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ পর্যন্ত অর্থ পাচার রোধ সংক্রান্ত বিষয় ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন তাদের নাম, ঠিকানা, স্টেটাস জানাতে বাংলাদেশ ব্যাংকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে ২০০৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আর্থিক খাত দেখে ওইসব কর্মকর্তার নাম এবং অর্থপাচারের বিষয়ে তারা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে কি না জানতে চেয়েছেন আদালত। এ ছাড়া পি কে হালদারের সাথে অর্থ আত্মসাতে জড়িত ৮৩ জনের বিরুদ্ধে দুদক কী ব্যবস্থা নিয়েছে সে বিষয়ে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে।
এর আগে গত বুধবার পি কে হালদারের সাথে অর্থ আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগে সন্দেহভাজন ৮৩ জনের বিরুদ্ধে দুদক কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এর আগে গত ১৩ জানুয়ারি পি কে হালদারের সাথে অর্থ আত্মসাতে জড়িত ৮৩ জনের সংশ্লিষ্টতার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট হাইকোর্টে দাখিল করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। প্রতিবেদনে বলা হয়, সার্বিক পর্যালোচনায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদ, শীর্ষ ব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ, চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার, ক্রেডিট ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় পি কে হালদার ও তার সহযোগীরা ৮৩ ব্যক্তির ঋণের আড়ালে নানাবিধ অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির দুই-তৃতীয়াংশের বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন মর্মে প্রতীয়মান হয়।
গত ৫ জানুয়ারি পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুরসহ ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। সাবেক প্রধান বিচারপতির পরিবার, সাবেক রাষ্ট্রদূতসহ পাঁচ আমানতকারীর আবেদনে এ আদেশ দেন।
গত ৩০ নভেম্বর আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে পি কে হালদারকে বিদেশ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে এবং গ্রেফতারে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা জানতে চান।
গত ২৫ অক্টোবর ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) আইনজীবী মাহফুজুর রহমান মিলনের মাধ্যমে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল ও দুদদ আইনজীবীকে জানিয়েছেন অসুস্থজনিত কারণে আপাতত দেশে আসছেন না তিনি। এর আগে আইএলএফএসএলের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে করা আবেদনে বলা হয়, ২৫ অক্টোবর দুবাই থেকে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আসার জন্য তিনি টিকিট কেটেছেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ অক্টোবর হাইকোর্ট তাকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন। আইনজীবীরা জানান, পি কে হালদার বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের সদর দফতর থেকে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে নানা কৌশলে দেড় হাজার কোটি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে আরো দুই হাজার কোটি টাকা বের করে বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
পি কে হালদারের সহযোগী ও তার মেয়ে ৩ দিনের রিমান্ডে : আদালত প্রতিবেদক জানান, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের মামলায় রিলায়্যান্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের সহযোগী সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধাকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তাদেরকে ঢাকার মহানগর সিনিয়র বিশেষ জজ কে এম ইমরুল কায়েসের আদালতে হাজির করে তিন দিনের রিমান্ড চান। আদালত শুনানি শেষে তাদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে গতকাল সকাল ১০টা থেকে দুদকের প্রধান কার্যালয় সেগুনবাগিচায় তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বেলা ১টায় তাদের গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ায় তাদের গ্রেফতার করেন সংস্থার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন।
পি কে হালদারের সহযোগী হিসেবে পরিচিত যে ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন উচ্চ আদালত, তার মধ্যে সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতাও রয়েছেন। পরে এ দুজনসহ ৬২ জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে দুদক। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় বিভিন্ন ব্যক্তিকে ব্যবহার করে তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা সরিয়েছেন পি কে হালদার। এ ছাড়া, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাতিয়েছেন প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশই পাচার হয়েছে বিদেশে। এ ব্যাপারে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ও তাদের দেয়া তথ্য যাচাই বাছাই করার জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তিন দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করলে আদালত সে আবেদন মঞ্জুর করেন।
এর আগে গত ১৩ জানুয়ারি পি কে হালদারের বান্ধবী অবন্তিকা বড়ালের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন একই আদালত। তারও আগে ৪ জানুয়ারি পি কে হালদারের নিকটাত্মীয় শঙ্খ বেপারির তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।
পি কে হালদার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আইএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে বছরের শুরুতেই পি কে হালদার বিদেশ পালিয়ে যান।

 


আরো সংবাদ



premium cement