১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সংসদে প্রথম প্রান্তিকের বাজেট বাস্তবায়ন প্রতিবেদন পেশ

করোনার প্রভাবে কমে গেছে সরকারি ব্যয়

বেড়েছে রেমিট্যান্স রিজার্ভ, রাজস্ব ও রফতানি আয়
-

করোনাভাইরাসের কারণে কমে গেছে বাজেট বাস্তবায়ন। একই কারণে হ্রাস পেয়েছে এডিপি বাস্তবায়ন ও পণ্য আমদানি। তবে এরপরও দেশের অর্থনীতি সঠিক পথেই রয়েছে বলে মনে করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। তিনি বলেছেন, করোনার প্রভাবে সরকারি ব্যয় কমেছে। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ কমেছে। অন্য দিকে আমদানি ব্যয় ১১.৪৩ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১২.৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। মূলত মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কিছুটা কম হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসের প্রেক্ষাপটে আমদানি ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে পেশকৃত ‘বাজেট ২০২০-২১ : প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও আয়-ব্যয়ের গতিধারা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ’ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে তিনি এ সব কথা বলেন।
প্রতিবেদনে তিনি বলেছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতি ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এ মহামারী সমগ্র পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি আমূল বদলে দিয়েছে। এ বৈশ্বিক প্রভাব থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দীর্ঘ সাধারণ ছুটির কারণে কল-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সাময়িকভাবে স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল। তবে কোভিড-১৯ মহামারী থেকে উত্তরণে সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে বাংলাদেশ সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে। গড় আয়ু, মাথাপিছু আয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ অগ্রগতি সাধন করেছে। আমাদের অর্থনীতির সুদৃঢ় অন্তর্নিহিত শক্তি ও বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক চালিকাশক্তিগুলোকে সঠিক পথে এগিয়ে নেয়ার মাধ্যমে আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবো।
অর্থমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা কিছুটা শ্লথ হয়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ হার কিছুটা কমে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রবাস আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ ও মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি মৌলিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক চলকগুলোর অবস্থান বেশ সন্তোষজনক। সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত অবস্থা বিরাজ করছে। টাকা-ডলার বিনিময় হার স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। অন্য দিকে রফতানি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সরকারের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসায় অচিরেই আমদানি বিশেষত মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানিতে গতি ফিরে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা যাচ্ছে। তিনি বলেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছি। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন শেষে সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। আমরা দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১)-এর বাস্তবায়নও শুরু করেছি। আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়া। বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বাস্তবায়ন এবং বদ্বীপ পরিকল্পনা, ২১০০ বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সরকারি ব্যয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ব্যয় ২৬ দশমিক ২৬ শতাংশ ও পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় ১ দশমিক ২৮ শতাংশ কমেছে। তবে সামনের দিনগুলোতে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর জোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আলোচ্য সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে মোট বরাদ্দের ৮ দশমিক ২ শতাংশে, যা বিগত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে আমদানি ব্যয় আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমেছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। মূলত মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কিছুটা কম হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসের প্রেক্ষাপটে আমদানি ব্যয় কমেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সেপ্টেম্বর শেষে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ৩২ দশমিক ০২ শতাংশ বেড়েছে। এর বিপরীতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এটি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২.০২ শতাংশ কম।
‘সরকারি খাতে অধিক ঋণপ্রবাহ মুদ্রা ও আর্থিক খাত ব্যবস্থাপনায় কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না’ বলে অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে দাবি করেছেন। উপরন্তু বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হলেও সরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মুদ্রা জোগানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
এ দিকে সরকারি ব্যয় কম হওয়ার কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাজেট উদ্বৃত্ত হয়েছে ২ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। বিগত অর্থবছরে একই সময়ে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। অন্য দিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ ও অনুদান প্রাপ্তি উভয়ের পরিমাণ বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজস্ব খাতে চলমান সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’ (এনবিআর)-এর আওতাধীন কর রাজস্ব আদায় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৪.১১ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে রফতানি আয় বেড়েছে ২.৫৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক (২.৯৪ শতাংশ)। রফতানি বাণিজ্যের এই প্রবৃদ্ধি করোনার প্রভাব থেকে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। অন্য দিকে প্রথম প্রান্তিকে প্রবাস আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৮.৫৪ শতাংশ, যা বিগত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৬.৮১ শতাংশ। গত ৩০ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়ে ৩৯.৩১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
অর্থমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবেলা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি দিকনির্দেশনায় সরকার সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সংবলিত ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার (জিডিপির ৪.৩৪ শতাংশ) ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যার বাস্তবায়ন কাজ বর্তমানে পুরোদমে চলছে।


আরো সংবাদ



premium cement