২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে চীনের গ্যারান্টি চায় ঢাকা

পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আজ
-

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-চীন ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আজ ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হবে। এতে রাখাইনে গ্রাম বা এলাকাভিত্তিক প্রত্যাবাসন এবং এ নিয়ে চীনের গ্যারান্টির ওপর গুরুত্ব দেবে বাংলাদেশ। একইসাথে প্রত্যাবাসনের ওপর আস্থা বাড়াতে রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি জাতিসঙ্ঘ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান, চীন, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার বেসামরিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত এক বা একাধিক দলের উপস্থিতি চায় বাংলাদেশ।
ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে থাকবেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পার্মানেন্ট সেক্রেটারি (পররাষ্ট্রসচিব) আই চেন এবং চীনের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার (পররাষ্ট্রসচিব) লিও জাওহু। বৈঠকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও তাদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ বিশেষ করে চীনের গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা চাইবে।
ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করছে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতাধর দুই স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া। দেশ দুু’টির বিরোধিতার কারণে নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব আনা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ বারবার চেষ্টা করেও এই ইস্যুতে রাশিয়ার মনোভাবে পরিবর্তন আনতে পারেনি। তবে চীনের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক বেশ জোরালো। এই প্রেক্ষাপটে শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে চীনকে সক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ।
এই ইস্যুতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যস্থতায় বেইজিং ও নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মন্ত্রী পর্যায়ের দু’টি বৈঠক হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক এবং ঢাকায় নিযুক্ত চীন ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটি একাধিক বৈঠকে মিলিত হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাবাসন নিয়ে বাস্তব ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে খুবই সামান্য।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য বসবাসের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপকে অব্যাহতভাবে উপেক্ষা করে যাচ্ছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। আন্তর্জাতিক চাপে ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সাথে একটি চুক্তি সই করেছে মিয়ানমার। কিন্তু এর পর থেকেই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এই চুক্তি বাস্তবায়নের পথ বন্ধ করে রেখেছে দেশটি। পাশাপাশি প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ার দায় বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে আসছে। ২০১৮ সালের আগস্ট এবং পরবর্তী বছরের নভেম্বরে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণে শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিকত্বসহ রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে প্রত্যাবাসনে অস্বীকৃতি জানায়।
প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের আস্থায় আনতে আসিয়ান, চীন, ভারতসহ মিয়ানমারের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের তত্ত্বাবধানে রাখাইনে বেসামরিক নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব জাতিসঙ্ঘে দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মিয়ানমার এতে কোনো সাড়া দেয়নি।
চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমার ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরের পরে আসা ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা এবং ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে আসা সাত লাখ রোহিঙ্গাকে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য যোগ্য বিবেচনা করবে। মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিডোতে ২০১৮ সালের ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে যৌথ করিগরি গ্রুপের (জেডব্লিউজি) বৈঠকে প্রতি সপ্তাহে ১৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ। আর মিয়ানমার তাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবার ও রোববার ছাড়া প্রতিদিন ৩০০ করে সপ্তাহে সর্বোচ্চ দেড় হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। দুই পক্ষের সমঝোতা অনুযায়ী প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানো হতে পারে ধারণা করেছিল বাংলাদেশ। সেই হিসাবে মিয়ানমার যথাসময়ে নিয়মিতভাবে তালিকা যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া সাত লাখ ৮৭ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে সাত বছরের বেশি সময় লাগবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রেই মিয়ানমার মূল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে।
প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং এ জন্য কোনো সময়সীমা নির্ধারিত নেই। মিয়ানমার শুধু একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
প্রত্যাবাসনের জন্য যাচাই-বাছাই করতে ইতঃপূর্বে পাঁচ লাখ ৯৮ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছে বাংলাদেশ। গত ১১ জানুয়ারি আরো দুই লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অর্থাৎ মোট আট লাখ ২৮ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে দেয়া হয়েছে। এসব রোহিঙ্গার সবারই বায়োমেট্রিক ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার এ পর্যন্ত যাচাই-বাছাই করে মাত্র ৪২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা প্রত্যাবাসনের জন্য চূড়ান্ত করেছে। তার পরও নানা অজুহাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াই ঠেকিয়ে রেখেছে। মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও কক্সবাজার থেকে রাখাইনে ফিরতে পারেনি।


আরো সংবাদ



premium cement