১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সৌদিতে বসবাসকারী ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ‘বাংলাদেশী’ বলছেন রাষ্ট্রদূত

চাপের মুখে অবস্থান বদলাবে ঢাকা?

-

সৌদি আরবে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া ও দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন দেশটির রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল-দুহাইলান। তাদের রোহিঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত করতে নারাজ তিনি। রাষ্ট্রদূতের যুক্তিÑ যেহেতু তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরব গেছে, তাই তারা বাংলাদেশী। গতকাল রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে সৌদি দূতাবাস আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে রাষ্ট্রদূত এ মনোভাবের কথা ব্যক্ত করেন। সৌদি বাদশাহ সালমান মানবিক সহায়তা ও ত্রাণ কেন্দ্র কর্তৃক বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ৩০ হাজার খাদ্যঝুড়ি বিতরণ উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
তিনি বলেন, কোনো বাংলাদেশী নাগরিক যদি রোহিঙ্গা হিসেবে সৌদি আরবে গিয়ে থাকে, তাদের পাসপোর্ট না থাকলে অবশ্যই আমরা পাসপোর্ট ইস্যু করব। কিন্তু যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পরিচয় দিয়ে আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি গেছে, তারা পাসপোর্ট নবায়ন করার আবেদন করলে নিশ্চয়ই বিবেচনা করা হবে। আর যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরব যায়নি, তাদের বিষয়টি বিচার-বিশ্লেষণ করে আমরা চিন্তা করে দেখব।
এই ইস্যুটি নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, যাদের কোনো ডকুমেন্ট নেই তাদের কেন বাংলাদেশ পাসপোর্ট দেবে। সৌদি আরব সে দেশে অবস্থানরত কমপক্ষে ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিতে যে চাপ দিচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ রাজি নয় বলে তিনি জানান। তখন ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্য একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে যে, পাসপোর্ট দেয়া না হলে সৌদি আরবে কর্মরত অভিবাসী বাংলাদেশীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেয়া হচ্ছে।
সৌদি আরবে বাংলাদেশের নতুন নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত জাভেদ পাটোয়ারীর সাথে প্রথম বৈঠকেই সৌদি কর্তৃপক্ষ সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তখন বিবিসিকে জানান। তিনি উল্লেখ করেন, ‘সৌদি আরব বলেছে, তাদের দেশে স্টেটলেস লোক তারা রাখে না। তাদের দেশে থাকা ৫৪ হাজার রোহিঙ্গার কোনো পাসপোর্ট নাই। তারা বলেছে, তোমাদের বাংলাদেশ থেকেতো রোহিঙ্গা অনেকে এখানে এসেছে, সুতরাং তোমরা এদের পাসপোর্ট ইস্যু করো।’
সে সময় সৌদি প্রস্তাবে রাজি না হলে সৌদি আরবে থাকা কমপক্ষে ২২ লাখ বাংলাদেশীর জন্য বিষয়টি হুমকি সৃষ্টি করবে বলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে বলা হচ্ছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সেখানে উসকানি দেয়ার যথেষ্ট দুষ্ট লোক আছে। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌদি কর্তৃপক্ষের ভালো সম্পর্কের কারণে সেখানে এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করছে, যা প্রায় ২২ লাখ। কিন্তু অন্যান্য দেশ যারা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, তারা কিন্তু খুব অসন্তুষ্ট। তাদেরও লোকজন সেখানে আছে, তারা বিভিন্ন রকমের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন এই প্রসঙ্গে বলেন, এর আগেও দুই-একবার সৌদি আরব রোহিঙ্গাদের ইস্যু তুলেছে, কিন্তু তারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়Ñ এটাই বাংলাদেশের অবস্থান ছিল। কিন্তু তার কোনো প্রভাব শ্রমবাজারে পড়েনি। সাবেক রাষ্ট্রদূত মসিহ অবশ্য তখন উল্লেখ করেন, রোহিঙ্গা ইস্যু সেখানে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।
তবে বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, ২২ লাখ শ্রমিকের বিষয় যখন আসবে, তখন সৌদি চাপে বাংলাদেশ অবস্থানে অনড় থাকতে পারবে কিনা সেই সন্দেহ তাদের রয়েছে। গতকালের সৌদি রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে মনে হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে রিয়াদের চাপ বাড়তে পারে বাংলাদেশের ওপর।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত ঈসা গতকাল বলেন, সৌদি আরব ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতা অনেক উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। সৌদিতে বসবাসকারী ৫৫ হাজার বাঙালি বা বাংলাদেশী রয়েছে, যাদের পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ বা হারিয়ে গেছে। এর একটি তালিকা আমরা বাংলাদেশকে দিয়েছি। তালিকায় থাকা বাংলাদেশীদের পাসপোর্ট হয় নবায়ন করতে হবে অথবা তাদের জন্য নতুন করে পাসপোর্ট ইস্যু করতে হবে। বিষয়টি দেখার জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি রয়েছে। এই কমিটির সাথে আমরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি।
সৌদিতে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের আপনারা বাঙালি বলছেন কেন? জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, কেননা তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরব এসেছিল। এ জন্য তারা বাঙালি বা বাংলাদেশী। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগামী ১৯ জানুয়ারি ঢাকা আসছেন কিনা জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, নতুন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সফরটি স্থগিত করা হয়েছে। আশা করি তা নিকট ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিত হবে। সফরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া অন্য ইস্যুগুলো সুরাহা দ্রুততর করার চেষ্টা করা হবে।
ঢাকায় সৌদি দূতাবাস প্রতিদিন কতগুলো ভিসা দিচ্ছে? উত্তরে তিনি বলেন, গত ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে দূতাবাস নতুন ভিসার আবেদন গ্রহণ শুরু করেছে। আমরা প্রথমে দিনে এক হাজার ৫০০ ভিসা দিচ্ছিলাম, যা এখন ছয় হাজারে পৌঁছেছে। এ ছাড়া দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা সৌদি এয়ারলাইন্স ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা সহায়তা দিয়ে আসছি। বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে সার্বিক প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করতে আমরা গত বছর জানুয়ারিতে ইস্যু করা মেয়াদ উত্তীর্ণ পুলিশ প্রতিবেদনও গ্রহণ করছি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এই সময় সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যাটা আজকের না। ৫০-৬০ বছর আগেও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে। সে সময় সৌদি আরব রোহিঙ্গাদের উদারভাবে আশ্রয় দিয়েছে। সৌদির একটা অঞ্চলে রোহিঙ্গারা থাকে। বাংলাদেশে ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় নেয়া এসব মানুষ সবাই রোহিঙ্গা। তারা মিয়নামারের অধিবাসী এবং বাংলাদেশী নয়।
এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন এই ইস্যু নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা বলেছি, ওদের যদি আগে কখনো বাংলাদেশের পাসপোর্ট থাকে কিংবা যদি কোনো প্রমাণ দেখাতে পারে, তাহলে আমরা অবশ্যই তাদের পাসপোর্ট ইস্যু করব। অন্যথায় আমরা কিভাবে করি? তখন তারা বলেছে, পাসপোর্ট ইস্যুর অর্থ এই নয় যে আমরা তাদের তোমাদের দেশে বিতাড়িত করব। তারা বলেছে, যেহেতু স্টেটলেস লোক সৌদি আরবে রাখা হয় না, সেজন্য পাসপোর্ট দিতে বলছি। যাদের বাংলাদেশের কোনো ডকুমেন্ট নাই, তাদের আমরা পাসপোর্ট দেবো কেন? আমরা তাদের বলেছি, তোমরা মিয়ানমারের সাথে এটা নিয়ে কথা বলো। তো, এ নিয়ে আলোচনা চলছে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের বক্তব্য হচ্ছে, সৌদি আরবই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে তাদের দেশে আশ্রয় দিয়েছিল। ১৯৭৭ সালে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে নির্যাতিত হচ্ছিল, তখন তৎকালীন সৌদি বাদশাহ ঘোষণা করেন যে, তিনি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবেন। তাই অনেক রোহিঙ্গা সৌদি আরবে যায়। এরা ৩০ বা ৪০ বছর ধরে ওই দেশে আছে। ওদের ছেলেমেয়ের সেখানে জন্ম হয়েছে। কিন্তু ওদের কোনো পাসপোর্ট নাই।
ড. মোমেন বলেন, ‘এর আগে সৌদি আরবে জেলে থাকা ৪৬২ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আনার জন্য বলেছিল। সেখানে বাংলাদেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারা যাচাই করে দেখেছেন যে জেলে থাকাদের মধ্যে ৭০ বা ৮০ জনের মনে হয় বাংলাদেশের পাসপোর্ট ছিল। বাকিদের ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না। যাদের বাংলাদেশের পাসপোর্ট ছিল, আমরা তাদের ট্রাভেল ডকুমেন্ট দিয়ে নিয়ে আসব। কিন্তু যাদের নাই, তাদের আমরা আনব কেন?’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসিকে বলেন, সৌদিতে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেয়া হলে, সেটা মিয়ানমার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে। মিয়ানমার তখন বলতে পারবে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের লোক। ফলে সৌদির প্রস্তাব অনুযায়ী পাসপোর্ট দেয়া ঠিক হবে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যেও এমন ইঙ্গিত আসছে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন মনে করেন, সৌদি আরবের অর্থনীতি আগের মতো শক্তিশালী নেই। এখন রোহিঙ্গাদের নিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষের এই অবস্থানের ক্ষেত্রে সেটা একটা কারণ হতে পারে। এখনকার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এমন হতে পারে যে তাদের ওখানে এমপ্লয়মেন্ট বা কাজের সুযোগ অনেক কমে আসবে। তারা এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে দেখছে, যাতে এ রকম চাপ দিয়ে কিছু বিদেশী শ্রমিক কমিয়ে ফেলা যায়।
৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেয়া না হলে সৌদি আরবে কর্মরত প্রায় ২২ লাখ বাংলাদেশীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার একটা আশঙ্কা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ে শিগগিরই দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ে একটি বৈঠক হতে পারে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সৌদি রাষ্ট্রদূতের এখনকার বক্তব্যেও সেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় সৌদি আরব ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন ভালো। কিন্তু এখন সৌদি আরবের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে আনার বিষয়কে সন্দেহের চোখে দেখছেন সাবেক কূটনীতিকদের অনেকে।
তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ‘এই সময় তাদের এই চাপ প্রয়োগ, এটা খুবই দুঃখজনক। কারণ সৌদি আরব নিজেদের মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে দাবি করে। সেখানে তারা দেখছে যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সঙ্কট চলছে। তখন তারা ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে পাসপোর্ট দেয়ার কথা বলছে।’
একইসাথে তিনি বলেন, সৌদি আরবের কোনো বিষয়েই সমর্থনের কোনো অভাব বা ঘাটতি দেখায়নি বাংলাদেশ। সেখানে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে তিনি মনে করেন।
উল্লেখ্য, তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য খাতে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। আগামী মার্চে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বাংলাদেশে সফরে আসার কথা। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement