২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পাঁচ বছরে এডিপির বাস্তবায়ন হার সর্বনিম্ন

২০২০-২০২১ অর্থবছর
-

করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার ভালো ছিল। গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হার ছিল ৫৪ শতাংশ। কিন্তু জুলাই থেকে ডিসেম্বর-২০২০ অর্থাৎ করোনা পরবর্তীতে সেই হার ২৩.৮৯ শতাংশে নেমে পড়ে। বাস্তবায়নের এই হার গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় খরচও প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে। এর কারণ হিসাবে করোনার কারণে কৃচ্ছ্রতা সাধনের জন্য নির্দেশনা অনুযায়ী অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে সেই আলোকে ব্যয় করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়গুলো।
আইএমইডি সচিব বলছেন, ব্যবধান আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় তেমন বেশি নয়। আশা করছি সঠিক তদারকির মাধ্যমে এটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অগ্রাধিকার ও কৃচ্ছ্রতাকে টেকসই করে পরবর্তীতে বছরের বাকিটা সময় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে সুফল পাওয়ার আশা রয়েছে। তবে এটা যদি লোক দেখানো নির্দেশনা হয় তাহলে তা হবে, যেই লাউ সেই কদুর মতো। প্রকল্প বাস্তবায়নের এই ধীরগতি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর চিরাচরিত অভ্যাস। এ জন্য প্রয়োজন জবাবদিহিতা এবং কাজে শ্লথগতির জন্য আইনানুগ শাস্তির বিধান।
আইএমইডি প্রকাশিত এডিপির বাস্তবায়ন পর্যালোচনার তথ্য থেকে জানা গেছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এডিপির বরাদ্দ ছিল দুই লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জিওবি ৬২ দশমিক ৭৪ শতাংশ বা এক লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। আর প্রকল্প সাহায্য ৩২ দশমিক ৮৫ শতাংশ বা ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে ডিসেম্বর-২০২০ পর্যন্ত সময়ে প্রকল্পগুলোর বিপরীতে খরচ হয়েছে ৫১ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। এই খরচকেই বাস্তবায়নের হার হিসাবে প্রকাশ করা হয় সরকারিভাবে। এই বাস্তবায়ন হার গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
গত পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন হার ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৬.৫৯ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৭.৪৫ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৭.০২ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৭.২০ শতাংশ। এমনকি জিওবি অর্থ ব্যবহারের হারও গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবার সর্বনিম্ন। জিওবি’র টাকা গত অর্থবছরের একই সময়ে খরচের হার ছিল ২৯.০৮ শতাংশ, যা চলতি বছর হয়েছে মাত্র ২৪.০২ শতাংশ।
দেখা যায়, বৃহৎ বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৫ মন্ত্রণালয়ের একই সময়ে বাস্তবায়ন হার ২৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৪.৬৮ শতাংশ বাস্তবায়ন হার বিদ্যুৎ বিভাগের। শিল্প মন্ত্রণালয়ের হার ২৮.৪৬ শতাংশ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২৭.৫১ শতাংশ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ২৭.১০ শতাংশ। সেতু বিভাগ ১৯.৮০ শতাংশ। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ১৪.৬৩ শতাংশ। রেলপথ মন্ত্রণালয় ২৫.৩৪ শতাংশ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ২৩.২৬ শতাংশ।
এ দিকে পর্যালোচনা সভায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের সচিব মো: মাহবুব হোসেন প্রকল্প পরিচালকদের হুঁশিয়ারি করে দিয়ে বলেছেন, বিভিন্ন প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দকৃত অর্থ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সঠিকভাবে ব্যয় করতে হবে। সময়মতো সঠিকভাবে ব্যয় করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে গবেষণা খাতের বরাদ্দকৃত অর্থ কমানো যাবে না।
আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীর কাছে প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, খুব যে খারাপ অবস্থা তা না। বাস্তবায়ন হার ২ শতাংশের কিছু বেশি পিছিয়ে আছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায়। মনে রাখতে হবে আমরা কোভিড ও কোভিড পরবর্তী সময় পার করছি। যেটা পিছিয়ে আছি তা আমরা সহসাই কাটিয়ে উঠতে পারব বলে আমি বিশ্বাস করি। গত অর্থবছর যখন মহামারীর খুবই ভয়াবহ অবস্থা ছিল তখনো কিন্তু ৮০ শতাংশের বেশি বাস্তবায়নের হার ছিল। তখন মিডিয়াও চিন্তা করেছে কিভাবে এতটা হলো। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য নেতৃত্ব ও সরকারের সদিচ্ছার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এখানে নেতৃত্ব ভালো নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, সবচেয়ে কম অগ্রগতি হয়েছে ১.৭৯ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের। এখানে পূর্ত কাজ আছে। সেখানে টেন্ডারসংক্রান্ত কিছু বিষয় আছে। মামলার কারণে সেটা হয়নি।
এ দিকে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। এটা বহুল আলোচিত বিষয়। এডিপি বাস্তবায়নের জন্য যে আগাম প্রস্তুতি দরকার মন্ত্রণালয়গুলো সেটা করে না।
তিনি বলেন, এ ব্যাপারে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আর যেসব মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি শ্লথ তাদের ব্যাপারে আইনানুগ যে ব্যবস্থা নেয়া যায়, সেটা কার্যকর করতে হবে। তিনি বলেন, এসব শ্লথগতি করোনার কারণে না। গত কয়েক দশকের বাস্তবায়ন হার দেখলে চিত্রটা একই দেখা যাবে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, মনে হয় এখানে একটা শুভসংবাদ থাকতে পারে। বছরের শুরুতে জুলাই মাসে অর্থ বিভাগ থেকে একটা চিঠি দেয়া হয় সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে। বলা হয়েছিল আপনারা আপনাদের মন্ত্রণালয়ের এডিপির প্রকল্পগুলোর মধ্যে কোনটা বেশি, কোনটা মধ্যম এবং কোনটা কম অগ্রাধিকার প্রাপ্ত, তার একটা তালিকা করে জানান। তাদের চিন্তাভাবনা ছিল, রাজস্ব পরিস্থিতি যেহেতু খারাপ, তাই ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতা সাধন করা দরকার। কৃচ্ছ্রতার জন্য যেখানে কম অগ্রাধিকার প্রকল্প সেখানে অর্থছাড় আপাতত স্থগিত রাখা হবে। তিনি বলেন, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় টাকার অঙ্কেও ব্যয় কমেছে। জিওবির যে অর্থায়ন সেখানে বেশি কমেছে। এই চিত্র দেখে মনে হচ্ছে সেখানে কৃচ্ছ্রতা বাস্তবায়নের একটা প্রভাব আছে। অর্থ হলোÑ অপচয়মূলক ব্যয়গুলো কমানোর যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, তার ফলশ্রুতি এটা।
তিনি বলেন, অপচয় রোধের এই পদক্ষেপের কারণে অর্থ বাঁচল। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো। কারণ আমাদের রাজস্ব আয়ের অবস্থা ভালো না। সে হিসাবে কোথাও না কোথাও তো কাজ করতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যদি এটা করা হয়ে থাকে, যেখানে বিদেশী অর্থ এখন নেই, তাহলে তো এটা একটা ভালো সংবাদও হতে পারে। যদিও আমরা সুনির্দিষ্টভাবে জানি না কোন প্রকল্পে ব্যয় কমেছে। তিনি বলেন, আমার মনে হচ্ছে ইদানীং তো এমন দেখা যায় না। আমাদের আবার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা এখনো রয়েছে।
ড. জাহিদ বলেন, শুভসংবাদ অবশ্য মোটাদাগের নয়। এখানে অর্থছাড়টা প্রথম কিস্তি বন্ধ রাখা হয়েছে। পচা প্রকল্প যে বাদ দেয়া হয়েছে তা নয়। সেটা করা উচিত ছিল। পচা প্রকল্পে আমরা প্রথম প্রান্তিকের টাকা ছাড় না দিয়ে শেষ প্রান্তিকে এসে দিয়ে দিলাম, তাহলে তো লাভ হবে না। তিনি বলেন, অগ্রাধিকার যদি টেকসই না হয় তাহলে তো সেটা একটা লোক দেখানোর মতোই হবে। বোঝানো হলো আপাতত সামাল দিলাম। গর্তে পড়ার আগে আপনাকে একটু টেনে ধরলাম। তারপর ছেড়ে দিলাম।

 


আরো সংবাদ



premium cement