২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভাসানচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন শুরু

-

পুনর্বাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের একটি দল অবশেষে স্বেচ্ছায় ভাসানচর যাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রথমে ১০টি বাসে ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন রোহিঙ্গারা। উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠ এলাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলোতে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা আছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে বেশ কিছু রোহিঙ্গা ভাসানচর এলাকায় যেতে ট্রানজিট পয়েন্টের পথে রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ ব্যাপারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয় এবং জেলা প্রশাসনের কেউ কথা বলছেন না। তবে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরপ্রক্রিয়া নির্বিঘœ করতে র্যাব-১৫ ও র্যাব-৭ এর দুই ব্যাটালিয়ন সদস্য উখিয়া- কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মোতায়েনের কথা জানান র্যাবের আইন ও মিডিয়া বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ। র্যাব-১৫ এর কমান্ডার আজিম আহমেদ জানান, সকাল থেকেই তারা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। এ সংক্রান্ত কিছু ছবি ও ভিডিও সরবরাহ করেন তিনি।
সূত্র মতে, স্বেচ্ছায় যারা যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তাদের পাঠানোর মাধ্যমেই এ স্থানান্তরপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কক্সবাজারের উখিয়া- টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যেতে উখিয়া কলেজ মাঠে অস্থায়ী ট্রানজিট পয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। মাঠে একাধিক কাপড়ের প্যান্ডেল ও বুথ তৈরি করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনের কেউ মুখ খুলতে না চাইলেও রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপক আয়োজন চোখে পড়ার মতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে বেশ কিছু রোহিঙ্গা ট্রানজিট পয়েন্টে চলে আসেন। গতকাল ভোর থেকে আসা শুরু করেন অন্যরাও। আগে থেকে প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা ও খাদ্যসামগ্রী মজুদ করা হয়। উখিয়া কলেজ মাঠ থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু হয় সকালে।
সূত্র মতে, ইতঃপূর্বে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম ঘিরে ভাসানচর দ্বীপ ঘুরে আসে ২২টি এনজিওর প্রতিনিধিদল। ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের জন্য সেখানে মজুদ করা হয়েছে প্রায় ৭০ টন খাদ্যসামগ্রী।
বিভিন্ন ক্যাম্পের মাঝিরা জানান, অনেক রোহিঙ্গা পরিবার স্বেচ্ছায় ভাসানচর যেতে উদ্যোগী হচ্ছে। তাদের অনেকে বুধবার সন্ধ্যায় ট্রানজিট পয়েন্টে চলে যায়। বাকিরা গতকাল সকালে গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর এক কর্মকর্তা বলেন, বারবার অভিযোগ উঠেছে এনজিওদের প্ররোচনায় রোহিঙ্গারা ভাসানচর যাচ্ছে না। তাই এবারের যাত্রায় কোনো এনজিও রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে নই।
এ দিকে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে নৌবাহিনীর ১৪টি জাহাজ। প্রথম দুই মাস তাদের রান্নাকরা খাবার সরবরাহ করা হবে। এরপর নিজ নিজ বাসস্থানেই তারা রান্না করতে পারবেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ভাসানচর নেয়ার আগে ২২টি এনজিওর প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করে সরকারের পরিকল্পিত আয়োজনে সন্তোষ প্রকাশ করেন। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেন তারা।
সম্প্রতি দ্বীপটি ঘুরে দেখে গেছে পালস বাংলাদেশ সোসাইটি, কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ, ফ্রেন্ডশিপ, এসএডব্লিউবি, শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল : বাংলাদেশ, গ্লোবাল উন্নয়ন সংস্থা, আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার, সনি ইন্টারন্যাশনাল, আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন, হেলথ দ্য নিডি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, জনসভা কেন্দ্র, কারিতাস বাংলাদেশ, সমাজকল্যাণ উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস), সোশ্যাল এইড, সিডিডি, মুক্তি-কক্সবাজার, ভলান্টারি অরগানাইজেশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, আর টি এম ইন্টারন্যাশনাল, মাল্টি সার্ভ ইন্টারন্যাশনাল, আল্লামা ফয়জুল্লাহ ফাউন্ডেশন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ফর অল। এসব এনজিও সেখানে কাজও শুরু করেছে। এ দিকে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার পেয়ে আসছে এক লাখ রোহিঙ্গা ভাসানচরে যাচ্ছে। অবশেষে এর যাত্রা শুরু হওয়ায় উখিয়া-টেকনাফের সাধারণ মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
সূত্র জানায়, উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ে ঠাসাঠাসির বসবাস ছেড়ে ভাসানচরে যেতে তিন হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা রাজি হয়েছেন। তবে সবমিলিয়ে চার থেকে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত।
নোয়াখালীর হাতিয়ায় সাগরের মাঝে ভেসে থাকা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা সংবলিত ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে। বসবাসের যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তা দেখতে গত সেপ্টেম্বরে দুই নারীসহ ৪০ রোহিঙ্গা নেতাকে সেখানে নিয়ে যায় সরকার। তারা ভাসানচরের আবাসনব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ হন। তারা ক্যাম্পে ফিরে অন্যদের ভাসানচরে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। দু’বছর আগে সরকার ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তাদের অনিচ্ছার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না।
ভাসানচরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের অনেকে জানান, তারা ভাসানচর পরিদর্শন শেষে ফিরে আসা রোহিঙ্গা নেতাদের মুখে সেখানকার বর্ণনা শুনে বসবাস করতে যেতে রাজি হয়েছেন। তাদের মতে পাহাড়ের ঘিঞ্জি বস্তিতে বসবাসের চেয়ে ভাসানচর অনেক নিরাপদ হবে। এ ছাড়া ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য নির্মিত অবকাঠামো অনেক বেশি আধুনিক সুযোগসুবিধা সংবলিত মনে হয়েছে তাদের।
কোনো বলপ্রয়োগ ছাড়াই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যাওয়ার ইতিবাচক মনোভাব দেখে তাদের সেখানে পাঠানোর বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয় সরকার। রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে নিরাপদে ভাসানচরে পাঠাতে পারলে আরো অনেক পরিবার সেখানে যেতে আগ্রহী হবে বলে সরকার আশাবাদী।
অপর দিকে কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যাওয়ার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা যেন সব তথ্য জেনে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন সেটা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ।
বুধবার সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার যে পরিকল্পনা সরকার চূড়ান্ত করেছে তার সাথে জাতিসঙ্ঘের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই। এ স্থানান্তর প্রক্রিয়ার প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমে বা রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়ায় জাতিসঙ্ঘকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। স্থানান্তরের সার্বিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জাতিসঙ্ঘের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই।
এ দিকে গোটা পুনর্বাসনপ্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে সরকার কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। খোঁজ নিয়ে যায়, টেকনাফের শামলাপুর ২৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লক থেকে ভাসানচরের উদ্দেশে প্রথম ধাপে পাঁচ পরিবারের ২৭ জন নারী-পুরুষ শিশুসহ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প ছেড়েছে। এখানে নিয়ে যাওয়া হবে ২২ পরিবার। গত বুধবার বিকেল ৪টার দিকে ক্যাম্প ক্লোজ করে সিআইসি অফিসের সামনে মেরিনড্রাইভ থেকে দু’টি মিনিবাসে করে প্রয়োজনীয় মালামালসহ কুতুপালংয়ের ট্রানজিটের উদ্দেশে চলে যায় সৈয়দ আলম, নূর মোহাম্মদ, আব্দু শুক্কুর, জুহুরা খাতুন ও সেতারা বেগমের পরিবারের ২৭ জন। এভাবে টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প হতে শত শত রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচরে যাওয়ার জন্য ক্যাম্প ছেড়েছে। সেখান থেকে বাসযোগে চট্টগ্রামের নেভাল ঘাটে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। তারপর ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা হবে তারা এমনটি জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোহিঙ্গা কমিউনিটির এক নেতা। এভাবেই ধাপে ধাপে বাকি নির্বাচিত রোহিঙ্গারা পযার্য়ক্রমে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাবেন।
২৩ নম্বর ক্যাম্পের মাঝি আবুল হাশেম বলেন, ভাসানচরে যাওয়ার জন্য কাউকে জোর করা হয়নি। বাধাও দেয়নি কেউ। তারা নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছে। এ নিয়ে ক্যাম্পে কোনো ধরনের হইচই নেই, শান্ত রয়েছে ক্যাম্প। এ সময় ২৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ (সিআইসি) অফিস হল রোমে ক্যাম্প ইনচার্জ নাওশার বিন হালিম বলেন, ‘ভাসানচরে যাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত প্রথম ধাপে ক্যাম্প ত্যাগ করে আসা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যেতে কোনো রকম জোর করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে উপস্থিত পাঁচ পরিবারের রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ সদস্যরা স্বেচ্ছায় যাচ্ছে বলে মতপ্রকাশ করেন। এ ছাড়া তাদের প্রলুব্ধ বা জোর করা হয়নি বলেও নিশ্চিত করেন তারা।’
প্রসঙ্গত, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে প্রাণে বাঁচতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার পর পেরিয়ে গেছে ৩৯ মাস। এর মাঝে দুই দফা প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলেও রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পাঠানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে কক্সবাজারে শিবিরের ওপর চাপ কমানোর অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলকে ভাসানচরের দিকে পাঠানো হলো।
আরো সাড়ে ৩ হাজার যাচ্ছে আজ : এ দিকে শীর্ষ নিউজ জানায়, আজ শুক্রবার আরো সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নেয়া হবে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে স্থানান্তর কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে বলে জানা গেছে।


আরো সংবাদ



premium cement