১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সুজনের আলোচনায় সুশীলসমাজ

ইসি এখন বিবেকশূন্য

নির্বাচন, গণতন্ত্র এখন কবিগান; নির্বাচনে জনগণের সম্মতির প্রতিফলন নেই
-

নির্বাচন, গণতন্ত্র এখন কবিগান, ঘেঁটু গানের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র নেই, সেখানে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা অর্থহীন। বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটি বিবেকশূন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলে বিজ্ঞজনরা মনে করছেন। তাদের মতে, গণতন্ত্রের প্রকৃত ধারণার সাথে আমাদের চার দিকে যে অবস্থা দেখছি, তার কোনো মিল নেই। বাংলাদেশের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর হাতে সব নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে। এর মাধ্যমে এক ধরনের সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের পেছনের শক্তি হলো আদালত। কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত কোনো আদালতকে কমিশনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে দেখিনি। এটি সুস্পষ্ট যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অসততা ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ আমাদের অসংখ্য নাগরিকের ভোটাধিকার হরণ করেছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) উদ্যোগে গতকাল ‘গণতন্ত্র, নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন’ শীর্ষক একটি অনলাইন গোলটেবিল বৈঠকে সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা এসব মন্তব্য করেন। সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন স¤পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। সূচনা বক্তব্য রাখেন সুজন কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ড. শাহদীন মালিক। বক্তব্য রাখেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব: এম সাখাওয়াত হোসেন, সুজন নির্বাহী সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ, অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, বিচারপতি এম এ মতিন, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ, সুজন নির্বাহী সদস্য আলী ইমাম মজুমদার, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ ম ল, ফটোসাংবাদিক শহীদুল আলম, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার, সুজন সহসভাপতি ড. হামিদা হোসেন, সুজন জাতীয় কমিটির সদস্য সি আর আবরার, একরাম হোসেন, সুজন নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দর খান, সফিউদ্দিন আহমেদ, আকবর হোসেন প্রমুখ।
লিখিত প্রবন্ধে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণতন্ত্র হলো জনগণের সম্মতির শাসন, যে সম্মতি প্রতিষ্ঠা হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচনের মাধ্যমে এক বা একাধিক বিকল্পের মধ্য থেকে জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের প্রতিনিধিত্ব করার লক্ষ্যে বেছে নেয়। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাপ্ত ক্ষমতা জনগণের স্বার্থে ও কল্যাণে ব্যবহার করে। তবে বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ ক্ষমতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর অপব্যবহার ও কুক্ষিগতকরণ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কতগুলো প্রতিষ্ঠানÑ সাংবিধানিক, বিধিবদ্ধ ও রাষ্ট্রবহির্ভূত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সেস’ বা নজরদারিত্বের কাঠামো গড়ে তোলা হয়। এই নজরদারিত্বের কাঠামো কার্যকারিতা প্রদর্শন করলেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও কার্যকর হয়।
প্রবন্ধে বলা হয়েছে, আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে কয়েকটি সুস্পষ্ট দায়িত্ব দিয়েছে। দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে অগাধ ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে আমাদের সংবিধানে কমিশনকে আইন ও বিধিবিধানের সাথে প্রয়োজনে সংযোজন করারও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যে ক্ষমতা মূলত নির্বাচিত সংসদের। উপরন্তু নির্বাচনের সময়ে কোনোরূপ কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তদন্তসাপেক্ষে নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতাও আমাদের উচ্চ আদালত কমিশনকে দিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সময়ে বহু অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও আমাদের নির্বাচন কমিশন ছিল সম্পূর্ণ নির্বিকার অনেকগুলো গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে তারা তদন্ত করেছে বলেও আমরা শুনিনি।
সুজন বলছে, এটি অনস্বীকার্য যে, সরকার ও রাজনৈতিক দল, বিশেষত ক্ষমতাসীন দল না চাইলে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রায় অসম্ভব। এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও। তবে এ ক্ষেত্রে কমিশনের হতে একটি বড় অস্ত্র রয়েছে, যা হলো নির্বাচন বন্ধ করে দেয়া। যদি কমিশন মনে করে যে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ অনুপস্থিত, তা হলে নির্বাচন কমিশন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নির্বাচনের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির দাবি করতে পারে। অনেকের ধারণা যে, এক তরফা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে কাজী রকিবউদ্দিন কমিশন সাহসী ভূমিকা নিলে, আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসই হয়তো ভিন্ন হতো।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এটি সুস্পষ্ট যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অসততা ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ আমাদের অসংখ্য নাগরিকের ভোটাধিকার হরণ করেছে। এর মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের ব্যাপক আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের মধ্যে ধারণা জন্মেছে যে তারা ভোট দিতে চাইলেও ভোট দিতে পারবে না। আর ভোট দিলেও তারা ‘ফলাফল’ প্রভাবিত করতে পারবে নাÑ যারা জয়ী হওয়ার তারাই জয়ী হবেন। আমরা দেখেছি, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত ফলাফল বহুলাংশে বানোয়াট। তাই এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাই আজ ভেঙে পড়েছে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই অকার্যকর করে ফেলেছে। এ ছাড়াও আমাদের রাজনীতি আজ বহুলাংশে বিরোধী দল শূন্য হয়ে পড়েছে, যার দায় অবশ্য আমাদের প্রধান বিরাধী দলও এড়াতে পারে না।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশনের পেছনের শক্তি হলো আদালত। কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত কোনো আদালতকে কমিশনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে দেখিনি। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনাররা একটা আইনের মাধ্যমে নিয়োগ হওয়ার কথা। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না। তাই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইন প্রণয়ন করে, যাতে তাদের নিয়োগপ্রক্রিয়া স¤পন্ন হয় সে দিকে আমাদের জোর দিতে হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, নির্বাচন, গণতন্ত্র এসব এখন কবিগান, ঘেঁটু গানের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র নেই সেখানে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা অর্থহীন। বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটি বিবেকশূন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাদের বিবেকশূন্যতার কারণে নির্বাচন নিয়ে জনগণের আগ্রহ শূন্যের কোটায় গিয়ে ঠেকেছে।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, আগে জানতাম সামরিক শাসকরা বিরাজনীতিকরণ করে। একটা বেসামরিক সরকার যে এভাবে বিরাজনীতিকরণ করতে পারে এখন আমরা তাও দেখতে পাচ্ছি। আমি সবাইকে বলব সামনে স্থানীয় সরকারের যে নির্বাচনগুলো আছে সেগুলোকে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য।
শাহদীন মালিক বলেন, গণতন্ত্রের প্রকৃত ধারণার সাথে আমাদের চার দিকে যে অবস্থা দেখছি তার কোনো মিল নেই। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। কিন্তু তারা সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। এখনকার নির্বাচন যেন সত্তর ও আশির দশকের নির্বাচনের মতো হয়ে গেছে। গণতন্ত্র, নির্বাচন এসব বিষয় ক্রমাগত কল্পনার বিষয়ে পরিণত হচ্ছে।
আলী রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর হাতে সব নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে। এর মাধ্যমে একধরনের সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কে প্রধানমন্ত্রী সেটি কোনো বিষয় না। নির্বাহী বিভাগের এই যে ক্ষমতা তৈরি হয়েছে এটিকে আলোচনা না করে শুধু কমিশন নিয়ে আলোচনা করলে লাভ হবে না।
আবু সাঈদ খান বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তিনটি কাজ করা দরকার বলে আমি মনে করি। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতায়ন, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ এবং নির্বাচনী আইন পরিবর্তন করে এলাকাভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে একটি মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থাতে যাওয়া।
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের প্রধান অংশীদার হলো সরকার। কমিশন গঠনের জন্য যেসব সার্চ কমিটি গঠন করা হয় এগুলোতে সরকার যাকে যায় সে রকম লোকই বেরিয়ে আসে। মন্ত্রিপরিষদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা থেকেও এটি দেখেছি। তাই সরকার না চাইলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা খুবই দুরূহ।
আবদুল লতিফ ম ল বলেন, কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে না, নির্বাচন পরিচালনা করে মাঠ প্রশাসন। মাঠ প্রশাসন নিরপেক্ষ না থাকলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। দীর্ঘ দিন একই সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে ৯০ ভাগ সরকারি কর্মচারী দলীয় হয়ে পড়েছেন। কাজেই মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
আসিফ নজরুল বলেন, আমরা সবাই জানি কমিশন, প্রশাসন দলীয় অঙ্গসংগঠনের পরিণত হয়েছে এটিই প্রধান সমস্যা। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারা আবার ভালোমতো কাজ দায়িত্ব পালন করেছেন। সুতরাং আমাদেরকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের কথা জোরে শোরে বলতে হবে।
দিলীপ কুমার সরকার বলেন, সাংবিধানিকভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশন কী ধরনের ভূমিকা পালন করছে তা আমরা সবাই অবগত।
এম এ মতিন বলেন, সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাজনীতি করা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। তাই এই অনুচ্ছেদকে সামনে এনে জনগণের মধ্যে প্রচার করার মাধ্যমে তাদেকে সচেতন ও সংগঠিত করে তুলতে হবে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এখন যা হচ্ছে এগুলোকে নির্বাচন বলা যায় না। ক্ষমতায় যখন যারা থাকে তারা আর ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। এই রাজনৈতিক দর্শন পরিবর্তনের জন্য জনগণের দিক থেকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের একটা রূপরেখা তৈরি করা দরকার বলে আমি মনে করি।
এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, আমরা অনেক কথা বলছি, কিন্তু যারা শোনার তারা শুনছেন না বা শুনলেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাই একটা ব্যাপক গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করা দরকার। তা হলে হয়তো কিছু হতে পারে। এ জন্য আমাদেরকেই নেতৃত্ব দিতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল