১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পুলিশের নামে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি!

-

রাজধানীর পুরান ঢাকার বাবুবাজার ব্রিজের নিচে হকার্স লীগের কার্যালয় ঘিয়ে চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে। অভিযোগ রয়েছে, ওই অফিসে বসে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন সংগঠনটির সভাপতি পিন্সু হাজী ও সাধারণ সম্পাদক আনসার ভূঁইয়া। তারা মামাতো-ফুফাতো ভাই। দুই শিফটে ভাগ হয়ে এ দু’জন বাদামতলী ফলের আড়তে ফল নিতে আসা পরিবহন থেকে চাঁদা আদায় করাচ্ছেন।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাবুবাজার ব্রিজের নিচে আওয়ামী হকার্স লীগের অফিসের পেছনের সরকারি জায়গা দখল করে আরেকটি চাঁদাবাজ চক্র সেখানে প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক দোকান বসিয়েছে। সাংবাদিক পরিচয় দেয়া কয়েক যুবকের নেতৃত্বে ভাসমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। এই চাঁদাবাজদের কোতোয়ালি ও বংশাল থানা পুলিশের একটি টহল দলকেও পাহারা দিতে দেখা গেছে। প্রতিদিন ভোরে বিভিন্ন জেলার ফল ব্যবসায়ীরা ট্রাক, কনটেইনার, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ ভ্যান বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুর নিচে পার্কিং করে দেশের সবচেয়ে বড় ফলের পাইকারি মোকাম বাদামতলী থেকে ফল কিনে বোঝাই করে আবার খালাসও করেন। মধ্যরাত থেকে পরিবহনগুলো পার্কিং শুরু করে। এজন্য প্রতিটি ট্রাক থেকে ১৫০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব চাঁদা আদায়ের জন্য তার ২০ থেকে ২২ জন লাইনম্যান রয়েছে। এদের মধ্যে মেহেদীর আপন ভাই ইউনুস (৩০), ভাগ্নে ছালাম (২৫), রুবেল গাজী (২৮), রানা (২৭), হৃদয় (২৬), মিন্টু (৩০), রফিক (২২), সাইফুল (৫০), জসিম (৩২), বাদশা (২৮), আনিস (৩৫), শহিদুল (৪০) ও কালু (৩৮)। এসব লাইনম্যানকে দিয়ে বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ, নয়াসড়ক ফাঁড়ির, বংশাল ফাঁড়ির, কোতোয়ালি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার, কোতোয়ালি থানার ওসি, ওসির ড্রাইভারসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নামে ফুটপাতে তিন শতাধিক দোকান বসিয়ে চাঁদা তোলা হচ্ছে। অবৈধ চাঁদা আদায়ে তাদের হাতে লাঠিও দেখা গেছে। যদি কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকার করেন, তাহলে তাকে মরধর করা হয়।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মান্নানের ছত্রছায়ায় এসব চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। তাকে প্রতি সপ্তাহে ১৫ হাজার টাকা চাঁদার ভাগ দেয়া হচ্ছে। চাঁদাবাজরা স্বদলবলে প্রতি শুক্রবার সকাল ৭টার মধ্যে পুলিশের চোখে ধুলা দিয়ে চার শতাধিক দোকানদার থেকে দুই লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। মেহেদী, তার ভাই ইউনুস ও ভাগ্নে সালামকে দিয়ে প্রতিদিন ভোরে নয়াবাজার মাজারের পাশের দোকান বসিয়ে প্রতি দোকান থেকে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করছেন। নয়াবাজার ফ্রেন্স রোডের নিত্যপণ্যের বাজার থেকে দোকানপ্রতি ২০০ থেকে ৫০০ টাকা করে বংশাল থানার বড় কর্তাদের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা তোলা হয়। প্রতিদিন ভোরে এ বাজারের প্রায় ২০০ দোকানদার থেকে কয়েক হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চাঁদাবাজরা। বংশালের আরমানিটোলা, কোতোয়ালির বাবুবাজার গোপিনাথ দত্ত লেন ও ব্রিজের নিচের অর্ধশতাধিক ট্রান্সপোর্ট রয়েছে। এসব ট্রান্সপোর্ট থেকে প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা করে আদায় করে তারা। একই এলাকায় ব্রিজের নিচে ২৭টি ভাসমান ভাতের হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলপ্রতি দৈনিক ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা এবং বাবু বাজার মিটফোর্ড চৌরাস্তা, কমিটিগঞ্জ সড়ক, আঁকমল খান সড়ক ও ব্রিজের নিচের দুই শতাধিক ভাসমান দোকানদার থেকে ৮০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তুলছে মেহেদী।
ইতঃপূর্বে ব্রিজের যানজট নিরসন ও চাঁদাবাজি বন্ধের জন্য সরকারি উদ্যোগে দুই দফায় বাবুবাজারের সিঁড়ি বন্ধ করলে চাঁদাবাজ মেহেদী স্বদলবলে সিঁড়ির প্রাচীর ভেঙে দেয়। এরপর সে ব্রিজের ওপর পরিবহন থেকে দৈনিক এক হাজার টাকা করে চাঁদার ভাগ নিচ্ছে। তার বিরুদ্ধে এমন অংসখ্য চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে পিরোজপুর সদর থানায় মেহেদী ও তার ভাই ইউনুসের নামে মামলা হয়। পরে তারা পুলিশের তাড়া খেয়ে ঢাকার বাবুবাজারে চলে আসে। এরপর তারা দুই চাকার ঠেলা ভ্যানে শসা ও আমড়া বিক্রি শুরু করে। পরে দুই ভাই ওই ব্যবসা ছেড়ে ২০০৯ সালের প্রথম দিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের স্টাফ, ডোম মিলনের টং দোকান ভাড়া নেয়। এরপর কমিটিগঞ্জ সড়কে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের নতুন গেটের পাশে আটার রুটি ও ডাল-ভাজি বিক্রি আরম্ভ করে। এর পাশাপাশি মেহেদী ডিউটি পুলিশের সাথে সখ্য গড়ে ফুটপাতের দোকান থেকে পুলিশের নামে চাঁদা তোলা শুরু করে। ২০১১ সালের আগস্ট মাসে আহসান মঞ্জিলের পাশে বাদামতলী সড়কে ফুটপাতের ফলের দোকান থেকে চাঁদা নেয়ার সময় র্যাবের হাতে আটক হয় মেহেদী। ওই মামলায় দ্রুত বিচার আইনে তার দুই বছর তিন মাস সাজা হয়। উচ্চ আদালতে আপিল করে চার মাস ১০ দিন পর জামিনে মুক্তি পান মেহেদী। জেল থেকে বেরিয়ে পুনরায় পুলিশের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা আদায়ে কোমর বেঁধে মাঠে নামেন।
মেহেদী পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে তাদের ব্লাকমেইল করে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা চাঁদাবাজি করছেন। পঞ্চম শ্রেণী পাস মেহেদী বর্তমানে কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। এলাকার সচেতন মহল মনে করে মেহেদী পুলিশ প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজি করে দেশের গোটা পুলিশ বাহিনীর ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করছে। গতকাল শুক্রবার ভোরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মেহেদীর ভাগ্নের নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জন যুবক অবস্থান করছে। সেখানে তারা বলেন, পুলিশ, স্থানীয় কাউন্সিলরকে ভাগ দিয়েই দোকান বসানো হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পাইকারি ফলের বাজারকে টার্গেট করে চাঁদাবাজ চক্রের নেতৃত্ব দেন পিন্সু হাজী ও আনসার ভূঁইয়া। তারা হকার্স লীগের অফিসে বসে নিয়ন্ত্রণ করেন চাঁদাবাজি। বাদামতলীর সীমানায় গাড়ির চাকা ঢুকতে হলে ব্রিজের নিচে তাদের চাঁদা দিতেই হয়। বাদামতলী ও আশপাশ এলাকায় ব্যবসায়ী ও পরিবহন চালকরা জানিয়েছেন চাঞ্চল্যকর এ তথ্য।
স্থানীয় পুলিশের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, তারা একাধিকবার ওই এলাকায় গেছেন। যারা টাকা নিচ্ছে তারা পুলিশকে বলেছে সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিয়েই দোকান বসিয়ে ভাড়া আদায় করছে। স্থানীয় কাউন্সিলর আব্দুল মান্নানের সেলফোনে যোগাযোগ করা হলেও তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল