২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফুটবল মানে ম্যারাডোনা

-

ফুটবল কিংবদন্তি ম্যারাডোনা দুনিয়ার তাবত ফুটবল ভক্তদের কাঁদিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আর কখনো তিনি আসবেন না। তবে ফুটবলে তার জাদুর চমক রূপকথা হয়ে থাকবে দর্শকদের হৃদয়-মনে। তারা কখনো ভুলবে না সর্বকালের সেরা অনন্য এই ফুটবলারকে। ভুলবে না এই ফুটবল জাদুকরকে। কারণ তাকে ভোলা যায় না।
ম্যারাডোনার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এ লেখা। সামনাসামনি তাকে কখনো দেখিনি। বাংলাদেশে ম্যারাডোনাকে আনার একবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। আশা ছিল কাছ থেকে একনজর তাকে দেখে চোখ জুড়াবো। সেই সুযোগ হয়নি। ১৯৮২ সালে তাকে প্রথম দেখি টেলিভিশনে। এরপর ১৯৮৬ ও ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে দৈনিক বাংলার স্পোর্টস টিমের সাথে কাজ করতে গিয়ে ম্যারাডোনাকে ভালোলাগা, ভালোবাসা ও তার ভক্ত হওয়া। ম্যারাডোনার খেলা অন্য অনেকের মতো আমাকেও জাদুর মতো স্পর্শ করেছিল।
নব্বইয়ের বিশ্বকাপ ফাইনাল নিয়ে দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় ‘ম্যারাডোনার কান্না’ শিরোনামে রিপোর্ট লিখতে গিয়ে আমিও অঝোরে কেঁদেছিলাম। সে দিন মাঠে ম্যারাডোনার প্রতি অবিচার করা হয়েছিল। বিতর্কিত গোলে জার্মানিকে জিতিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমরা দৈনিক বাংলায় লিড নিউজের শিরোনাম করেছিলাম ‘বিতর্কিত গোলে জার্মানির বিশ্বকাপ জয়’।
আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ারসের এক বস্তিতে ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর জন্ম ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনার। আর ৬০ বছর বয়সে গত ২৫ নভেম্বর স্থানীয় সময় দুপুরে একই শহরের তিগ্রেতে নিজ বাসভবনে তার জীবন প্রদীপ নিভে যায়। অসুস্থতার খবর পেয়ে দ্রুতই ছুটে এসেছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু ততক্ষণে তিনি কোটি কোটি ভক্তকে বিদায় জানিয়ে দেন। হার্ট অ্যাটাকের সাথে পেরে ওঠেননি। ডিব্রল করে বেরিয়ে যেতে পারেননি, যেমনটা ফুটবল মাঠে খেলোয়াড়দের ডিব্রল করে তিনি বেরিয়ে যেতেন। যদিও মস্তিষ্কে সফল অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয়ে মাত্র কয়েক দিন আগেই তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন।
ম্যারাডোনার মৃত্যুর খবরে গোটা দুনিয়ার ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। ফুটবলের রাজা পেলে শোক জানাতে গিয়ে বলেন, ‘কী দুঃখের খবর। আমি আমার অসাধারণ এক বন্ধুকে হারালাম। এখন অনেক কিছুই বলা হবে। আপাতত তার পরিবারকে শোক সইবার শক্তি দিন সৃষ্টিকর্তা। আশা করি, আমরা এক দিন স্বর্গে ফুটবল খেলব।’ আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্ডেজ ম্যারাডোনার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আপনি আমাদের বিশ্বের সেরা বানিয়েছেন। জীবনে অপরিমেয় সুখ এনে দিয়েছেন। ডিয়েগো আপনি অবারিত যে আনন্দ আমাদের দিয়েছেন, সেই অনুভূতি কখনো মুছে যাবে না।’ ম্যারাডোনার খুব আদরের লিওনেল মেসি বলেন, ‘তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, আবার যাননি। কারণ ডিয়েগো চিরন্তন।’ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বলেন, ‘ডিয়েগো সর্বকালের সেরাদের একজন। এক অনন্য ফুটবল জাদুকর।’ জিনেদিন জিদান বলেন, ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে অসাধারণ খেলে তিনি আমার মনে অমলিন দাগ রেখে গেছেন। কিলিয়ান এমবাপ্পে বলেন, শান্তিতে ঘুমান কিংবদন্তি। পুরো পৃথিবীকে আনন্দ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।’
ফরাসি ফুটবল কিংবদন্তি জিদান সঠিকই বলেছেন। ছিয়াশির বিশ্বকাপে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। অনন্য সাধারণ ফুটবল নৈপুণ্য তাকে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম ফুটবলারে পরিণত করে। ম্যারাডোনার মনোমুগ্ধকর খেলায় গোটা জগৎ বিস্ময়ে অভিভূত হয়। ম্যারাডোনার একক কৃতিত্বেই বলা যায়, ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ শিরোপা আর্জেন্টিনার হাতের মুঠোয় আসে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এই খেলায় ‘ঈশ্বরের হাত’ নামে যে গোলটি করেছিলেন ম্যারাডোনা, তার জন্য তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন ঠিক। কিন্তু এর মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথায় অবিশ্বাস্য নৈপুণ্যে ছয়জন ইংলিশ খেলোয়াড়কে ডিব্রল করে গোলকিপার পিটার শিলটনকে বোকা বানিয়ে তার পরের যে গোলটি তিনি করেন, তা এখনো ‘সর্বকালের সেরা গোল’ বা গোল অব দ্য সেঞ্চুরি খ্যাত। ইংল্যান্ড দলের সাবেক ম্যানেজার ববি রবসন বলেছিলেন, ‘ম্যারাডোনার প্রথম গোলটি সন্দেহজনক, কিন্তু দ্বিতীয়টি ছিল ঐন্দ্রজালিক।’ ম্যারাডোনার সেই অনন্য সাধারণ গোল এখনো জ্বলজ্বল করে ভাসছে চোখে।
বিশ্ব ফুটবল ফেডারেশন ফিফার দৃষ্টিতে শতাব্দীর সেরা দু’জন ফুটবলারের একজন পেলে, অন্যজন ম্যারাডোনা। তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে চারটি বিশ্বকাপ খেলার খেলেছেন। ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৯০ সালে রানার আপ করান তিনি।
সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে? এ প্রশ্নে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় বিশ্ব। পেলের সাথেই ম্যারাডোনার সবচেয়ে বেশি তুলনা হয়। ফুটবলের রাজা পেলে ব্রাজিলকে তিনটি বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। তবে প্রতিটি বিশ্বকাপেই তার সতীর্থ খেলোয়াড়রাও ছিলেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি খেলোয়াড়। কিন্তু ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার সতীর্থদের একজনকেও এমন কাতারে আনা যাবে না। বাংলাদেশের ফুটবল তারকা ও ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি সালাহউদ্দিন যথার্থই বলেছেন, ফুটবল ১১ জনের খেলা। কিন্তু ম্যারাডোনা ছিলেন একাই একটি দল। ১০ জন এক দিকে আর ম্যারাডোনা একাই ১০ জনের সমান। এককভাবে একটি দলকে টেনে নেয়ার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল তার। আর্জেন্টিনাকে প্রায় একক নৈপুণ্যেই ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপ পাইয়ে দিয়েছিলেন। তার মতো এমন ফুটবলার আর আসবে না।
ম্যারাডোনা তার জীবনে ৪৯১টি ফুটবল ম্যাচে ৪৯১টি গোল করেছেন। আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেছেন ৯১টি ম্যাচ এবং গোল করেছেন ৩৪টি। মাত্র ষোলো বছর চার মাস বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবলে তার অভিষেক হয়। আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়র্স ছেড়ে ম্যারাডোনা যখন স্পেনের বার্সেলোনা যান ৩ মিলিয়ন পাউন্ডের চুক্তিতে তখন সেটা ছিল বিশ্ব রেকর্ড। তেমনি বার্সেলোনা থেকে যখন ৫ মিলিয়ন পাউন্ডে ইতালির ন্যাপোলিতে যান সেটাও ছিল বিশ্ব রেকর্ড। অন্য খেলোয়াড়দের চেয়ে তিনি ছিলেন খর্বাকার। উচ্চতা ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। তবে বল যেন তার কথা শুনত। ফুটবলে তার পায়ের ঝিলিক দর্শকদের মাঝে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিত। বলে তার কন্ট্রোল, অনন্য ড্রিবলিং, দ্রুত পাস দেয়ার ক্ষমতা এতটা অসাধারণ ছিল যে, এর কাছে অন্য দুর্বলতা অনায়াসে চাপা পড়ে যেত।
তবে দুঃখজনক হচ্ছে ম্যারাডোনার জীবনটা সবসময় সরলরেখায় চলেনি। এক দিকে ফুটবল জাদুতে তিনি দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন, অন্য দিকে জড়িয়েছেন বিতর্কে। কখনো মাদক, কখনো ইতালির মাফিয়া চক্রের সাথে সখ্য। উত্থান পতনে ভরা তার জীবন। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ তিনি খেলতে পারেননি ডোপ টেস্টে ধরা পড়ার কারণে। ১৯৯১ সালেও শরীরে মাদকের উপস্থিতি ধরা পড়ায় ১৫ মাসের জন্য তিনি নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৯৭ সালে ৩৭তম জন্মদিনে তিনি পেশাদার ফুটবল থেকে বিদায় নেন। তিনি ফুটবল কোচও হয়েছিলেন।
ম্যারাডোনা আর ফুটবল এক সমার্থক নাম। অনেকের কাছে ফুটবল মানেই ম্যারাডোনা। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ আর্জেন্টিনার সমর্থক ম্যারাডোনার কারনে। ম্যারাডোনা ভালোবাসার নাম। আর্জেন্টিনার জাতীয় দল আর নাপোলির জার্সিতে কীর্তিগুলো ম্যারাডোনার নামকে কখনো নিষ্প্রাণ হতে দেবে না। ম্যারাডোনার জাদুর পা-কে কেউ কোনোদিন ভুলবে না।
(সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাব)।


আরো সংবাদ



premium cement