১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গণমাধ্যমের ওপর চাপ বৃদ্ধিতে উদ্বেগ টিআইবির

উৎসবমুখর নির্বাচন জাদুঘরে যাচ্ছে; ধর্ষণ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে
-

করোনা সঙ্কটকালে স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি এবং গণমাধ্যমের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক চাপ বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সদস্যদের বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণকারী সদস্যবৃন্দ।
একই সাথে, কোভিড-১৯ এর ন্যায় বৈশি^ক বিপর্যয় মোকাবেলা ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তরুণদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত; জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠানের বিকাশ; ব্যাংকিং খাতের প্রতি সাধারণের আস্থা ফেরাতে সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে একটি সুশাসিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন ২০১৯-২০ বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণকারীরা। দেশে বিদ্যমান দুর্নীতির মহোৎসব নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্যান্য সংস্থার যথেষ্ট আইনগতভিত্তি থাকা সত্ত্বেও তারা সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা। সদস্যবৃন্দ মনে করেন, বিভিন্ন সময়ে টিআইবির কার্যক্রম ও গবেষণা প্রতিবেদন সম্পর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিরূপ মন্তব্য করা হয়, যা প্রকারান্তরে দায় এড়ানোর অপচেষ্টা বলে প্রতীয়মান হয়। এ ক্ষেত্রে টিআইবি যেমন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্মোহ থেকে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ থেকে বিরত থাকতে বদ্ধপরিকর, একইভাবে সংস্থাটির সাথে সম্পৃক্ত সদস্যবৃন্দও ব্যক্তি ও পেশাগত জীবনে রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
গতকাল বৃহস্পতিবার আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সভায় টিআইবির সাথে স্বেচ্ছাসেবারভিত্তিতে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার ৪৪ জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঞ্চালনায় সভায় সভাপতিত্ব করেন টিআইবির সাধারণ পর্ষদে সদস্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধি কাজী মো: মোরতুজা আলী। সভায় উপস্থাপিত ২০১৯-২০ অর্থবছরে টিআইবি পরিচালিত গবেষণা, অধিপরামর্শমূলক ও প্রচারণাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম এবং সংশ্লিষ্ট আর্থিক হিসাবের সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন নিরীক্ষা প্রতিবেদন সম্পর্কে সদস্যগণ ইতিবাচক মন্তব্যের পাশাপাশি সার্বিক কার্যক্রমের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
সভা শেষে এক ঘোষণাপত্রে উপস্থিত সদস্যবৃন্দ করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশেও নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়া এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতের অভাবে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে অপরাধীর যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করার জোরালো আহ্বান জানান সদস্যবৃন্দ। একই সাথে, দুর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য খাতের সঙ্কট কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে আরো গভীরতর হয়েছে বলে মন্তব্য করার পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দুর্নীতির নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং তা ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছাতে সুযোগ সন্ধানী, দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতির সুবিধাভোগীরা পরস্পর যোগসাজশে দুর্নীতির মহোৎসবে নেমেছে। সরকার করোনা ভাইরাস মোকাবেলার বদলে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখাটাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে এবং এক ধরনের সঙ্কোচনমূলক নীতি অবলম্বন করেছে। ফলে তথ্য নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এবং স্বাস্থ্য খাতে জনগণের অভিগম্যতা কমে গেছে বলে মন্তব্য করেন তারা।
দেশে মৌখিকভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মুক্ত গণমাধ্যমের প্রচার থাকলেও বাস্তবে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় পদ্ধতিতেই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অন্য বিভিন্ন আইনের চাপে গণমাধ্যম নিজেও ‘সেল্ফ সেন্সরশিপে’ গুটিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, যা স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা ও বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। গণমাধ্যমের ওপর চাপ গণতন্ত্রের জন্য অশনিসঙ্কেত, যা আত্মঘাতীমূলক ও বুমেরাং হতে বাধ্য। তাই অবিলম্বে মুক্ত সাংবাদিকতার পথ উন্মুক্ত করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব মহলের কাছে জোর আহ্বান জানান সদস্যরা।
একটি প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং নিয়মরক্ষার প্রধান বিরোধী দল হওয়ায় সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় তাদের জোরালো ভূমিকার ঘাটতি দৃশ্যমান। অন্য দিকে নির্বাচন কমিশন যে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সেই সত্যটাও কমিশন সংশ্লিষ্টরা সম্ভবত ভুলে গেছেন। বাংলাদেশে এক সময় নির্বাচন যে একটি উৎসব হিসেবে বিবেচিত হতো, তা বর্তমান কমিশন জাদুঘরে পাঠানোর বন্দোবস্ত পাকাপোক্ত করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এমন বাস্তবতায় প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করার দাবি জানান সদস্যরা।
রাষ্ট্র মালিকানাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে জনগণের অর্থ ও আমানত নিয়েই ব্যবসা করে থাকেÑ এই বাস্তবতার স্বীকৃতি বাংলাদেশে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব জনগণের আমানত তদারকি এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করাÑ তারাও নেতৃত্বের অদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঋণ খেলাপিদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই সঙ্কট থেকে উত্তরণে অবিলম্বে সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং সরকার কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি কমিশন গঠন করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনাসহ কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে জবাবদিহিতার জায়গাটা এমন একপর্যায়ে আটকে আছে, সেখানে শুধু চুনোপুঁটি নিয়ে টানাটানি হচ্ছে। রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। একটা ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে আরেকটা নতুন ঘটনায়। এর কারণ হচ্ছে প্রভাবশালীদের যারা এসব অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত, তাদের কোনো না কোনোভাবে প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ হোক, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার একটা সূত্র পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় আছে। ব্যক্তির পরিচয় ও অবস্থানের ঊর্ধ্বে থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি দমনে যে আইনি এখতিয়ার দেয়া আছে তার যথাযথ প্রয়োগ হলে দেশে একটার পর একটা দুর্নীতির ঘটনা ঘটত না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত অবস্থান কেবল তার বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে কি না এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেন সদস্যরা।

 


আরো সংবাদ



premium cement