২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কঠোর শুদ্ধি অভিযান পুলিশে

ঢেলে সাজাতে ব্যাপক রদবদল; ডিএমপিতে চাকরি হারাচ্ছেন ২৬ পুলিশ সদস্য
-

ইমেজ পুনরুদ্ধার ও বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশে কঠোর শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। অপরাধের ধরন অনুযায়ী অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের শ্রেণিভিত্তিক তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ঘুষখোর, মাদকাসক্ত ও মাদক কারবারে জড়িত, মাদক কারবারিদের কাছ থেকে টাকা আদায়কারীসহ নানা ধরনের অপরাধ অনুযায়ী তালিকাটি করা হচ্ছে। এ ছাড়া সঙ্কটে পড়া পুলিশবাহিনী ঢেলে সাজাতে ব্যাপক রদবদল শুরু হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত কয়েক দিনে কক্সবাজার জেলায় কর্মরত পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত ১৫০৭ সদস্যকে বদলি করা হয়েছে। একক কোনো জেলার সব সদস্যকে এ ধরনের বদলি দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের আচরণে পরিবর্তন আনতে এই আদেশ বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন। এ দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) চাকরি হারাচ্ছেন মাদকাসক্ত ২৬ পুলিশ সদস্য। ১০০ জন সন্দেহভাজনের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের ডোপ টেস্ট করার পর ২৬ জনের পজিটিভ এসেছে। ডিএমপির হেডকোয়ার্টার্স সূত্রে জানা গেছে, শনাক্ত হওয়া ২৬ জনের মধ্যে সার্জেন্ট একজন, এসআই চারজন, এএসআই তিনজন, নায়েক একজন, ও কনস্টেবল ১৭ জন। ডোপ টেস্টে ধরা পড়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগই থানায় কর্মরত ছিল।
ডিএমপি সূত্র জানায়, সম্প্রতি ডিএমপির হেডকোয়ার্টার্স থেকে প্রত্যেকটি ইউনিট ও বিভাগের উপ-কমিশনারদের চিঠি দিয়ে সন্দেহভাজন মাদকাসক্ত সদস্যদের তালিকা করতে বলা হয়। বিভিন্ন ইউনিট ও বিভাগের উপ-কমিশনাররা তালিকা পাঠালে তা যাচই-বাছাই করে ১০০ জনের সন্দেহভাজন একটি তালিকা তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে সন্দেহভাজনদের ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সে ডেকে এনে তারা সত্যিই মাদকাসক্ত কি না তার জন্য ডোপ টেস্ট করানো হয়। এর মধ্যে ২৬ জনের পজিটিভ এসেছে।
গতকাল শনিবার সকালে মিরপুর অবস্থিত ডিএমপির নবসৃষ্ট ট্রাফিক মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় উদ্বোধন শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা: শফিকুল ইসলাম বলেন, মাদক নেয়া ২৬ জন পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, আমাদের বিশ্বাস এভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলে বাকিদের জন্য সুস্পষ্ট মেসেজ যাবে যে আমরা কাউকে ছাড় দিবো না। আমাদের এই উদ্যোগের ফলে অনেকে ভালো হয়েছে এবং এ রাস্তা থেকে ফিরে এসেছে। পুলিশ সদস্য যারা মাদকের সাথে সম্পৃক্ত আছে বা মাদক কারবারিকে সহযোগিতা করছে সরাসরি তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কোনো রকম শিথিলতা দেখানো হচ্ছে না। একজন সাধারণ মাদক কারবারির বিরুদ্ধে যেভাবে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে ঠিক সেভাবে মাদকের সাথে সম্পৃক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
কমিশনার বলেন, আমি ডিএমপি কমিশনার হিসেবে যোগদানের পর ডিএমপির প্রত্যেকটি ইউনিট ও বিভাগে গিয়ে কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে সব সদস্যকে বলেছি কেউ যদি মাদকাসক্ত হয় তারা যেন আমার কাছে আসে, তাদের মাদকাসক্ত থেকে ফিরিয়ে আনতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। কিন্তু স্বেচ্ছায় কেউ সাড়া দিয়ে আসেনি। এজন্য ডিএমপি থেকে উদ্যোগ নিয়ে ডোপ টেস্ট করানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রথম দফায় ১০০ জনের ডোপ টেস্ট করানো হয়েছে। এক মাস পর আবারো বড় আকারে এই প্রক্রিয়া চালানো হবে। প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কেউ সন্দেহভাজন হলে তাদেরও ডোপ টেস্ট করানো হবে। আমি এক মাস সময় নিচ্ছি। কারণ কেউ যদি মাদকাসক্ত হয়েও থাকে, সে যেন নিজে নিজে উদ্যোগ নিয়ে মাদক থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু ডোপ টেস্ট করে ধরা পড়লে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্স সূত্র জানায়, ডোপ টেস্টে মাদকাসক্ত ধরা পড়া পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। বিভাগীয় মামলার মাধ্যমে আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে। ডোপ টেস্টে ধরা পড়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগই থানায় কর্মরত ছিল। তাদের প্রত্যেকেই প্রাথমিকভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
জানা গেছে, পুলিশ সদর দফতর থেকে জারি করা বদলি আদেশগুলো গত দু’দিন ধরে একে একে পৌঁছায় চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের পাশাপাশি কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে। প্রথমে শুধু পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনকে বদলি করা হলেও তার পরদিন সাতজন অতিরিক্ত এবং সহকারী পুলিশ সুপারকে বদলি করা হয়। তৃতীয় দফায় পরিবর্তন করা হয় আট থানার অফিসার ইনচার্জসহ ৬১ ইন্সপেক্টরকে। সবশেষ গত শুক্রবার ১৩৯ জন এসআই, ৯২ জন এএসআই এবং এক হাজার ৫৫ কনস্টেবল ও নায়েককে গণহারে বদলির আদেশ দেয়া হয়।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, কক্সবাজারে ইতঃপূর্বে যারা কর্মরত ছিল আমরা বিশ্বাস করি সবাই ভালো কাজ করেছে। পরে আরো ভালো কাজ করবে সে জন্য আমরা পরিবর্তন এনেছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ক্যাসিনো ব্যবসার সাথে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের এরই মধ্যে শাস্তি দেয়া হয়েছে। তাদের বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে। যার মধ্যে পুলিশের শীর্ষপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তাও রয়েছেন। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার পর পুলিশে আবারো শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজন অনুভব করছে বাহিনীটি। সম্প্রতি নানা অপকর্মে দুই শতাধিক পুলিশ সদস্যকে বরখাস্তসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে ৫০ জনের বেশি। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৪ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে। সেসব অভিযোগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। সম্প্রতি অভিযোগের হার বেড়েছে। ফলে পুলিশ ভয়াবহ ইমেজ সঙ্কটের মুখে পড়েছে। সঙ্কট কাটাতেই দেশের ইতিহাসে একযোগে একক কোনো জেলার পুলিশের সব সদস্যকে বদলি মনে করছেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা। তবে পুরো পুলিশ প্রশাসনেরই আমূল পরিবর্তনের কথা বলছেন তারা।
কক্সবাজার থেকে বদলি হওয়া সব পুলিশ সদস্যকে আগামী ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নতুন ইউনিটে যোগ দিতে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি আনোয়ার হোসেন।
পুলিশ সদর দফতরের প্রজ্ঞাপনে বদলির এ আদেশকে ‘জনস্বার্থে’ বলা হলেও পুলিশ সূত্র বলছে, সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জে শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি, কক্সবাজারের এসপি, এডিশনাল এসপি, এএসপির পর এবার ৩৪ পরিদর্শককে বদলি করা হয় এবং সব শেষে জেলা পুলিশের এক হাজার ১৪১ জন কনস্টেবলকে বদলি করা হয়।
জানা গেছে, বর্তমান আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই পুলিশ সদর দফতরে পুলিশের প্রতিটি ইউনিট প্রধানের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে বিশেষ এক ঘোষণা জারি করেন। তিনি বলেন, যারা পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করে রাতারাতি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক হবেন বলে ভাবছেন বা সেই লক্ষ্য নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। তাদের পুলিশ বাহিনীতে জায়গা নেই। তারা ইচ্ছা করলে পুলিশের চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে পারেন। এখানেই শেষ নয়, যেসব পুলিশ সদস্য মাদকের সাথে জড়িত থাকবে তাদের চাকরিচ্যুত করার প্রকাশ্য ঘোষণা দেন পুলিশপ্রধান ও ডিএমপি কমিশনার মোহা: শফিকুল ইসলাম। পুলিশ বাহিনীতে ডোপ টেস্ট চালু করার প্রক্রিয়া চলছে। এটি চাকরির আগে এবং পরেও করা হবে। কোনো পুলিশ সদস্যের প্রতি সন্দেহ হলেই তাকে ডোপ টেস্ট বা মাদকাসক্ত কি না, তা পরীক্ষা করা হবে। যার রক্তে বা দেহে মাদক সেবনের আলামত পাওয়া যাবে, তাকে চাকরিচ্যুত করতে ন্যূনতম ভাবা হবে না। এ ছাড়াও নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্যের সাথে কোনো পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলে তার শাস্তি নিশ্চিত। এ ক্ষেত্রে কোনো ডাক দোহাই মানা হবে না। এমন বাণিজ্যের সাথে ৩০ পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে তদন্ত চলছে। এ ছাড়া যেসব পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে সারা দেশ থেকে ১৩ হাজার ৬০০ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সিকিউরিটি সেলে অভিযোগ জমা পড়ে ছিল। ২০১৭ সালে সে সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৬ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। গড়ে প্রতি বছর ১৫ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সিকিউরিটি সেলে অভিযোগ জমা পড়ে।
পুলিশ সদর দফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, শুদ্ধি অভিযানের একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও পরিকাঠামো গঠনের কাজ চলছে। সে মোতাবেক সারা দেশে দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement