১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ইস্যুতে সৌদি বাদশাহ ও যুবরাজ মতভেদ

-

ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের পথে সৌদি আরব হাঁটবে কি না চলমান গুঞ্জনের মধ্যে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুুল আজিজ এ বিষয়ে অসম্মতি জানিয়েছেন। ইসরাইলের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আগ্রহী হলেও বাদশাহ সালমান ইসরাইলের ব্যাপারে তার আগের অবস্থানে রয়েছেন।
সৌদি বাদশাহ সালমান আরব দেশগুলোর ইসরাইলকে বয়কট করা ও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবির দীর্ঘদিনের সমর্থক। তবে তার উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ ইসরাইলের সাথে ব্যবসা করতে ও ওই অঞ্চলে ইরানের বিরুদ্ধে শক্তিশালী জোটবদ্ধ গড়ে তুলতে চান।
গত ১৩ আগস্ট ইসরাইল ও আমিরাতে মধ্যকার সমঝোতা চুক্তি নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ঘোষণা দেন, ৮৪ বছর বয়সী বাদশাহ সালমান তা শুনে ‘স্তম্ভিত’ হয়ে পড়েন। তবে ট্রাম্পের ঘোষণায় অবাক হননি যুবরাজ মোহাম্মদ। আরব বিশে^র দু’টি দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে যে চুক্তি করেছে তাতে সৌদি বাদশাহ আর যুবরাজের মধ্যে মতানৈক্যের বিষয়টি এভাবেই ফুটে উঠেছে।
যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম অর্থনীতির প্রধান সৌদি আরবের বাদশাহ যদি ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি সমর্থন না করতেন তবে প্রতিবেশী দেশ আমিরাতের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হতো। আর তার উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদই আমিরাতকে ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করতে সাহায্য করেছেন।
শান্তিচুক্তির পর বাদশাহ সালমান তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি সৌদির যে দৃঢ় অবস্থান তা ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সৌদি মালিকানাধীন একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত মতামতে সৌদি রাজপরিবারের ঊর্ধ্বতন সদস্য প্রিন্স তুর্কি আল-ফয়সাল বলেন, সৌদি আরবের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে জেরুসালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘ইসরাইল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে চূড়ান্ত শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সৌদি আরব একটি মূল্য নির্ধারণ করেছে। আর তা হলো, সাবেক বাদশাহ আবদুল্লাহর উদ্যোগ অনুসরণ করে জেরুসালেমকে রাজধানী ঘোষণা করে সার্বভৌম একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা।’ সৌদি শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনার ইঙ্গিত দেয় যে, আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের বিষয়ে দেশটির অবস্থান প্রত্যাশার তুলনায় দ্রুতই বদলে যেতে পারে।
সময় এখন ইসরাইলের পক্ষে : সৌদি আরব ও ইসরাইল প্রায় ৩০ বছর ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে, বিশেষ করে ইরানের সম্পর্কিত নিরাপত্তা ইস্যুতে সতর্কতার সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রেখেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোট বজায় রাখার (বিশেষত ইরান মোকাবেলায়) পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দীর্ঘকালীন সমর্থন রাখার মতো দুটি বিপরীতমুখী লক্ষ্য অনুসরণ করতে গিয়ে সূক্ষ্ম রাস্তায় হাঁটছে সৌদি আরব। কখনো কখনো সৌদি কর্মকর্তাদের গোপনে এক অবস্থান এবং জনসাধারণের সামনে অন্য অবস্থান প্রচার করতে দেখা গেছে। এমনকি সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী কর্মকাণ্ডেও জড়িয়েছে সৌদি আরব।
সৌদি বিশ্লেষক ও মার্কিন কর্মকর্তাদের মতে, আধুনিক সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সৌদের ছেলে বাদশাহ আবদুল আজিজ তার জীবদ্দশায় আরব অঞ্চলে ইসরাইলের যে বিজয় উল্লাস দেখেছেন সেটি তার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত বাসেম আল আগা জানান, সিংহাসনে আরোহণের আগে সৌদি রাজধানীর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময়, বাদশাহ আবদুল আজিজ প্রায়ই নিজেকে ‘রিয়াদে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত’ হিসেবে উল্লেখ করতেন। কয়েক দশক ধরে বাদশাহ আবদুল আজিজ ফিলিস্তিনিদের কয়েক বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্যের পাশাপাশি তাদের বেশির ভাগ নেতার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। মিসর ও জর্দান আগেই ইসরাইলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করলেও এই গ্রীষ্মে আমিরাত ও বাহরাইনের চুক্তির আগে সব আরব রাষ্ট্রের অবস্থান ফিলিস্তিনের পক্ষেই ছিল।
ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি যুবরাজের সমর্থন রাখা দরকার : সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ওয়েস্টফাল বলেন, ‘২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় আসেন, বাদশাহ সালমান তাকে একটি বার্তা পাঠিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি ইসরাইলের অস্তিত্বের অধিকারের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্র থাকার অধিকারেও বিশ্বাস করেন।
মে মাসে প্রথম বিদেশ সফরের সময়, সৌদি আরব প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে রিয়াদ থেকে তেল আবিবে যাওয়ার অনুমতি দেয়। এমন সিদ্ধান্ত সৌদি আরবের প্রত্যাশা অনুযায়ী ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রতি নতুন মার্কিন প্রশাসন কাজ করবেÑ প্রবীণ বাদশাহর এমন প্রত্যাশাকেই ইঙ্গিত করে। তবে, শিগগির হতাশ হয়েছিলেন বাদশাহ সালমান।
প্রেসিডেন্টের জামাতা ও সিনিয়র উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার সৌদির কাছে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে এই অঞ্চলে পৌঁছানোর পর তিনি এমন একটি চুক্তি নিয়ে কথা বলেন যা ফিলিস্তিনিদের রাজধানী পূর্ব জেরুসালেমকে অস্বীকার করে। সেপ্টেম্বরে ফোনে যোগাযোগের সময় বাদশাহ সালমান ফিলিস্তিন ইস্যু সমাধান নিয়ে তার আকাক্সক্ষার কথা আবারও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে জানান।
ওই কথোপকথন নিয়ে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থায় প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত খবরে বলা হয়েছে, ফোনে তিনি ২০০২ সালের আগে সৌদি-সমর্থিত একটি উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিনিময়ে ইসরাইলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।
মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের কূটনীতি : নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল চুক্তির অধীনে আরো আরব দেশকে নিয়ে আসতে আগ্রহী ট্রাম্প প্রশাসন। একটি সূত্র জানায়, নিওমে গত ১ সেপ্টেম্বর এক সভায় যুবরাজ জানান, বাদশাহ কখনোই সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে সমঝোতা চুক্তিতে রাজি হবেন না। যুবরাজ সে সময় কুশনারকে জানান, সৌদি এখন সর্বোচ্চ যা করতে পারে তা হলোÑ বাহরাইনকে ইসরাইলের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তিতে রাজি করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে পারে। সৌদি আরব ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য বাহরাইনকে অনুমোদন দিয়েছে কি না জানতে চাইলে বাহরাইন সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, ‘আঞ্চলিক ন্যায়বিচার ও স্থায়ী শান্তি অর্জনের জন্য দেশটি তার সব কৌশলগত অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
সৌদি যুবরাজের অবস্থান : সৌদি যুবরাজ শুরু থেকেই ধর্মীয় উগ্রবাদকে নির্মূল ও ইসলামের আরো সহিষ্ণু দৃষ্টি প্রচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি সবসময় ইহুদি ধর্মসহ অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে সম্প্রীতি রাখার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। ২০১৮ সালে তিনি ইসরাইলিদের নিজস্ব জমিতে থাকার অধিকার আছে বলে জানান। সৌদি ও পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, ইসরাইলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের ঝুঁকিগুলো কী হতে পারে তা সৌদি যুবরাজ জানেন। এটা সৌদি আরবকে আঞ্চলিকভাবে মারাত্মক সমালোচনার মুখে ফেলবে। কেবল ফিলিস্তিনিদের পরিত্যাগ করার জন্য নয়, বরং ইসরাইলকে জেরুসালেমের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে ও ইসলামের তৃতীয়-পবিত্রতম স্থান আল আকসা মসজিদে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার মতো সিদ্ধান্তে সম্মতি দেয়ার কারণে সৌদি আরব আঞ্চলিক বিতর্কে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিক রান্ডেল ১৫ বছর সৌদি আরবে কর্মরত ছিলেন। তার মতে, সৌদি যুবরাজ ইসরাইলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সমঝোতায় পৌঁছানোর আগে অন্যান্য দেশ, বিশেষ করেÑ সুদান ও মরক্কোর মতো দেশ যেখানে সৌদির প্রভাব আছে, সেগুলোকে চাপ দেবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement