২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ৩ কিশোর হত্যা

পাঁচ কর্মকর্তার নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ড

খাবার ও চিকিৎসা না দিয়ে পালাক্রমে মারধর : ৬ ঘণ্টা পর মৃতপ্রায় অবস্থায় হাসপাতালে প্রেরণ
-

চুল কাটা নিয়ে বিরোধের সূত্র ধরে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঁচ কর্মকর্তার নেতৃত্বে কিশোর বন্দীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। রীতিমতো মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই নির্যাতন চালানো হয়। তাদের নির্যাতনে তিন কিশোর নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। পুলিশ ওই পাঁচ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে। এ ছাড়া নির্যাতনে অংশ নিয়েছিল কর্মকর্তাদের অনুগত সাত-আট কিশোর বন্দী।
গত বৃহস্পতিবার যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে হতাহতের ঘটনায় পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল শনিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন।
গ্রেফতাররা হলেনÑ কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুশফিক আহমেদ, ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর শাহানুর রহমান, টেকনিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর ফারুক হোসেন।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার জানান, ঘটনার সূত্রপাত ৩ আগস্ট। এ দিন কিশোর বন্দী হৃদয়কে (চুল কাটায় পারদর্শী) চুল কেটে দিতে বলেন কেন্দ্রের নিরাপত্তাপ্রধান (হেড গার্ড) নূর ইসলাম। ঈদের আগে প্রায় দুই শ’ বন্দীর চুল কাটায় হৃদয় তার হাত ব্যথা জানিয়ে চুল কাটতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নূর ইসলাম কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ আল মাসুদ ও সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহর কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘ওরা ট্যাবলেট খেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে রয়েছে।’ এ ছাড়া তিনি হৃদয় ও তার বন্ধু পাভেলের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্কের ইঙ্গিত করেন। সেখানে উপস্থিত কিশোর নাঈদ অভিযোগ শুনে বিষয়টি পাভেলকে জানিয়ে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাভেল তার কিছু অনুসারী কিশোরকে নিয়ে নূর ইসলামকে মারধর করে। এতে তার হাত ভেঙে যায়। এ ঘটনার সূত্র ধরেই ১৩ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
যা ঘটেছিল ১৩ আগস্ট : জাতীয় শোক দিবস পালন উপলক্ষে ১৩ আগস্ট কেন্দ্রে একটি সভা হয়। সভায় ১৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় ‘নূর ইসলামের ওপর হামলাকারীদের শান্তি প্রদানের’ সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শনাক্ত হামলাকারী ১৩ জনসহ আরো কয়েকজনকে বের করে আনা হয়। ওই পাঁচ কর্মকর্তার নেতৃত্বে কয়েকজন কর্মচারী এবং কর্মকর্তাদের আজ্ঞাবহ সাত-আটজন কিশোর বন্দী ‘অভিযুক্তদের’ মারধর শুরু করে। এ সময় তাদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়।
মুখে গামছা ঢুকিয়ে জানালা দিয়ে হাত বাইরে বের করে টেনে ধরে পেছনে বেধড়ক মারধর করা হয়। লোহার রড, ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে বেপরোয়া মারধর করা হয়। অচেতন হলে মার বন্ধ করা হয়। ফের জ্ঞান ফিরলে মারধর করা হয়। এভাবে মারধরের পর গুরুতর জখম অবস্থায় এদের একটি ঘরে ফেলে রাখা হয়। এদের হাসপাতালে না পাঠিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টা ফেলে রাখা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মৃতপ্রায় অবস্থায় একজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতাল থেকে তার মৃত্যুর খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জনসহ কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে দেখতে পান নির্যাতনের শিকারদের দুপুরে খাবার ও চিকিৎসা না দিয়ে গরমের মধ্যে গাদাগাদি অবস্থায় ফেলা রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে আরো দু’জনকে হাসপাতালে পাঠানো হলে তারাও মারা যায়। পরে অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের পিকআপে ১৪ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরদিন আরো একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
পরবর্তী পদক্ষেপ : ঘটনার পর কেন্দ্রের কর্মকর্তারা দু’পক্ষের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা বললেও পরবর্তীতে আহত কিশোরদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসতে শুরু করে। পুলিশ দ্রুত তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয়। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন নিহত পারভেজ হাসান রাব্বির বাবা খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়া। মামলায় শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে বিবাদি করা হয়। মামলার পর পুলিশ হেফাজতে নেয়া ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার দেখায়।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার জানান, তদন্ত কমিটির পাশাপাশি পুলিশও মামলার তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। মিটিংয়ে থাকা ১৯ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জড়িত হিসেবে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত হওয়ায় পাঁচ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড আবেদন করা হবে। এ ছাড়া জড়িত সাত-আট কিশোর বন্দীকে এ মামলায় আইনের আওতায় আনতে আদালতে আবেদন করা হবে বলে তিনি জানান।
জড়িত ১২ জন শনাক্ত : তিন কিশোরকে হত্যা মিশনে জড়িত ১২ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। যশোর ক সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম রব্বানি শেখ জানান, প্রাথমিক তদন্তে কেন্দ্রে বন্দীদের মারধর ও হত্যার ঘটনায় ১২ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুশফিক আহমেদ, ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর শাহানুর রহমান, টেকনিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর ফারুক হোসেন উপস্থিত থেকে মারধরে অংশ নেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তারা নির্যাতনের কাজে কেন্দ্রের বন্দী সাত কিশোরকে ব্যবহার করেন। জড়িত ওই সব কিশোরকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। রোববার আদালতের মাধ্যমে তাদের এ মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হবে।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দী তিন কিশোর হত্যার ঘটনায় সমাজসেবা অধিদফতর দুই সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তিন কর্মদিবসের মধ্যে এ কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement