২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ৩ কিশোর নিহত

‘দুই গ্রুপে সঙ্ঘাত নয়, কর্মকর্তারা পিটিয়ে হত্যা করেছে’

-

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোর নিহতের ঘটনা নিয়ে কর্তৃপক্ষ ও বন্দীরা একে-অপরকে দোষারোপ করে চলেছে। কর্তৃপক্ষের দাবিÑ যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তাদের ভাষ্য মতে ফলোআপ সংঘর্ষের ঘটনায় তিন কিশোর নিহত ও ১৪ জন আহত হয়েছে। এ দিকে যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোর ‘বন্দী’ খুনের ঘটনায় নতুন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দুই গ্রুপের সঙ্ঘাত নয়, কর্মকর্তারা ঠাণ্ডা মাথায় পিটিয়ে হত্যা করেছে তাদের। আহত কিশোররা বলছে, গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ডের সাথে দ্বন্দ্ব ও মারধরের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং অন্য বন্দীরা বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত তাদের হাত-পা-মুখ বেঁধে দফায় দফায় মারধর করেছে। অচেতন অবস্থায় তাদের ফেলে রাখা হয়। সে কারণে বিনা চিকিৎসায় তাদের তিনজন মারা যায়।
গত বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর রাতে যশোরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে যান। গভীর রাত পর্যন্ত তারা সেখানে থেকে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে খুলনা রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজিও আসেন। রাত ৩টার দিকে তিনি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে বের হন।
শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ জানান, কোরবানির ঈদের পর গত ৩ আগস্ট বন্দী রবিউল ও পাভেলের মধ্যে মারামারি হয়। এ সময় এই দুইজনসহ তাদের গ্রুপের বন্দীদের যার যার ইউনিটে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এরই জেরে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে দুই গ্রুপের মধ্যে ফের মারামারি হয়। এ ঘটনায় তিনজন নিহত ও ১৪ জন আহত হয়। যশোর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম পিপিএম সংবাদিকদের জানান, পুলেরহাটস্থ শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) বন্দীদের দু’টি গ্রুপ রয়েছে। এর একটি গ্রুপের নেতৃত্বে বন্দী পাভেল ও অপর গ্রুপের নেতৃত্বে বন্দী রবিউল। এই দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ২টার দিকে মারামারি হয়। এ ঘটনায় তিন বন্দী নিহত হয়।
বৃহস্পতিবার রাতে যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্দী চুয়াডাঙ্গার পাভেল বলে, ‘গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ড (আনসার সদস্য) নূর ইসলাম তার চুল কেটে দিতে বলেন। সেদিন কেন্দ্রের প্রায় দুই শ’ জনের চুল কেটে দেয়ায় আমার হাত ব্যথা ছিল। সে কারণে তার চুল পরে কেটে দেয়া হবে জানালে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে গালাগাল করতে থাকেন। একপর্যায়ে কয়েক কিশোর তাকে মারধর করে। বিষয়টি তিনি অফিসে জানান। নূর ইসলাম অভিযোগ করেন, কিশোররা মাদক সেবন করে তাকে মারধর করেছে। কিন্তু কিশোররা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে তারা মাদক সেবন করেনি।’
পাভেল আরো জানায়, ‘ওই ঘটনার পর বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে আমাদের অফিসে ডাকা হয় এবং এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। আহত আরেক কিশোর নোয়াখালীর বন্দী জাবেদ হোসেন জানায়, ‘স্যাররা ও অন্য বন্দী কিশোররা আমাদের লোহার পাইপ ও বাটাম দিয়ে মেরেছে।’
যশোরের বসুন্দিয়া এলাকার বন্দী ঈষান জানায়, ‘নিহত রাসেল আর আমি একই রুমে থাকতাম। আগামী মাসেই তার জামিনে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। স্যারদের বেদম মারধর আর চিকিৎসা না পেয়ে সে মারা গেছে।’ আহতরা জানায়, ‘মারধর করে তাদের ফেলে রাখা হয়েছিল। পরে একজন করে মারা গেলে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর রাত ৮টা থেকে ১১টার মধ্যে চার দফায় আহতদের হাসপাতালে আনা হয়।’
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রবেশন অফিসার মুশফিক আহমেদ বলেন, ‘সম্প্রতি কেন্দ্রে বন্দী কিশোরদের দুই গ্রুপের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এরই জেরে বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। রডের আঘাতে ও মারধরে মারাত্মক জখম হয় ১৪ কিশোর। প্রাথমিকভাবে উন্নয়ন কেন্দ্রেই তাদের চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় আশঙ্কাজনক আহতদের একে একে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে নাইম, পারভেজ ও রাসেলকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।’
পুলিশ হেফাজতে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ১০ কর্মকর্তা : যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে সংঘর্ষের ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি এবং কোনো তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়নি। তবে ওই ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কসহ ১০ কর্মকর্তাকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। কেন্দ্রের সামনে নিহত, আহত ও বন্দীদের স্বজনরা ভিড় করছেন। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আহাজারিতে শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছে। গত বৃহস্পতিবার শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) তিন কিশোর খুন হয়। এরা হলো পারভেজ হাসান রাব্বী (১৮), রাসেল ওরফে সুজন (১৮) ও নাঈম হোসেন (১৭)। ওই সময় আরো অন্তত ১৪ কিশোর গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক সার্কেল) গোলাম রব্বানী শেখ জানান, এই ঘটনায় শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত মামলা হয়নি। তবে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহ-তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুশফিকুর রহমান, শারীরিক প্রশিক্ষক শাহনূর রহমানসহ কেন্দ্রে কর্মকত ১০ জনকে শুক্রবার ভোরে পুলিশি হেফাজতে নেয়া হয়। তারা বর্তমানে যশোর পুলিশ লাইন্সের ব্যারাকে রয়েছেন।
৩ কিশোর হত্যা : তদন্ত কমিটি গঠন
যশোর অফিস জানায়, যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দী তিন কিশোর হত্যার ঘটনায় সমাজসেবা অধিদফতর দুই সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তিন কর্মদিবসের মধ্যে এ কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সমাজসেবা অধিদফতরের পাশাপাশি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ও একটি তদন্ত কমিটি গড়তে চলেছে। বলে নিশ্চিত করেছেন যশোরের জেলা প্রশাসক।
সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলাম ১৪ আগস্ট স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছেন, যশোরে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার তিন বন্দী কিশোর নিহত ও চার আহত হওয়ার সুষ্ঠু তদন্ত করার জন্য দুই সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেনÑ সমাজসেবা অধিদফতরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সৈয়দ মো: নুরুল বসির ও উপপরিচালক (প্রতিষ্ঠান-২) এস এম মাহমুদুল্লাহ। তিন কর্মদিবসের মধ্যে মহাপরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এ দিকে শুক্রবার দুপুরে যশোর জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার আহম্মেদ তারেক সামস নিহত তিন কিশোরের ময়নাতদন্ত করেছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাফিজুল হকের উপস্থিতিতে। ওই ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কসহ ১০ কর্মকর্তাকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। কেন্দ্রের সামনে নিহত, আহত ও বন্দীদের স্বজনরা ভিড় করছেন। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আহাজারিতে শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছে।


আরো সংবাদ



premium cement