২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

তদবিরের প্রকল্পে আজগুবি ব্যয়

-

দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম বা প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থের অপচয় নিয়ে সরকার বেশ বিব্রত। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও ক্ষুব্ধ। কোনোভাবেই এটি নিয়মে আনা যাচ্ছে না। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, বাধ্যবাধকতা থাকলেও সম্ভাব্যতা যাচাই না করে বস্তুনিষ্ঠতার চেয়ে তাড়াহুড়া করে বিভিন্নভাবে তদবিরেই প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে; উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৫০ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে। যাতে তা একনেক সভায় পেশ করতে না হয়। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ ও পরিবর্তনে পছন্দই মূল বিষয়। এখানে নিয়োগ কমিটির কোনো ভূমিকা থাকে না। সাধারণ প্রকৃতির প্রকল্প বাস্তবায়নে পরামর্শক সেবার প্রয়োজন না হলেও সেখানেও পরামর্শক সেবা খাতে অর্থ খরচ করা হচ্ছে বলে পরিকল্পনা কমিশন মনে করছে। আর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, মহামারী করোনার মধ্যে অনলাইনে মিটিং হয়েছে, তাহলে আবার শিঙ্গাড়ার খরচ কেন, প্রশ্ন তার। তিনি বলেন, আমরা অনলাইনে মিটিং করলাম।
প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য প্রকাশিত হওয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে মন্ত্রী এমন প্রশ্ন করেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবও উপস্থিত ছিলেন। সভায় কয়েকটি উপস্থাপনা তুলে ধরা হয় পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সভায় প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সমস্যাগুলোর ওপর পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) আবুল কালাম আজাদ তার পর্যালোচনা তুলে ধরেন। পর্যালোচনায় বলা হয়, ২৫ কোটি টাকার বেশি কোনো বিনিয়োগ প্রকল্প হলে আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। কিন্তু সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করে বা সঠিকভাবে স্টাডি না করে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। ফলে প্রকল্পের উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাচন করা হয় না। নকশা বা নির্মাণধর্মী কাজের ডিজাইন চূড়ান্ত না করেই প্রকল্পগুলো তৈরি এবং কমিশনে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হচ্ছে। এ ছাড়া প্রকল্প প্রণয়ন বা গ্রহণকালে বিভিন্ন সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। আবার আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়েই প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে। বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রস্তাবনার সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাহায্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তাপত্র সংযুক্ত করা হয় না। আবার প্রকল্প প্রণয়নকালে কম সময় দেয়া অর্থাৎ অত্যন্ত তাড়াহুড়া করে প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়। ফলে বস্তুনিষ্ঠতার সাথে তথ্যগত মিল থাকে না। প্রকল্পের ডিজাইন ত্রুটিপূর্ণ হয়; যা প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা সৃষ্টি করে বলে কমিশনের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সাধারণ প্রকৃতির প্রকল্পেও আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরামর্শক সেবা নেয়া হয়। অথচ ওই সব কাজ বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শক সেবার প্রয়োজন হয় না।
প্রকল্পের অস্বাভাবিক তথা আজগুবি ব্যয় প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সভায় জানানো হয়, প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণকালে যথাযথভাবে বাজারদর যাচাই করা হয় না। রেট শিডিউল অনুসরণ করে প্রাক্কলন করা হয় না। এমনকি প্রকল্পের স্থান পরিদর্শন না করে কাজের পরিমাণগত দিক বেশি বিবেচনায় নিয়ে ওভার এস্টিমেটেড বা অতিমাত্রায় ব্যয় প্রাক্কলন করা হচ্ছে। পাহাড়ি, কোস্টাল ও হাওর এলাকার ক্ষেত্রে সমতল এলাকার বাজারদর বা রেট শিডিউল ধরে প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। প্রকল্পের স্থান নির্বাচনে সিলেকশন কমিটি যথাযথ ভূমিকা পালন করে না। অন্যদিকে বাস্তবায়ন পর্যায়ের সমস্যাগুলো হলো- প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্যক জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তা বা ব্যক্তিদের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে পছন্দমাফিক ব্যক্তিদের প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ ও পরিবর্তন করা হয়। এতে নিয়োগ কমিটির কোনো ভূমিকা থাকে না। যাদের নিয়োগ দেয়া হয় তারাও কর্মস্থলে থাকে না। প্রকল্পের নির্মাণ কাজের গুণগত মান নিশ্চিতে নিবিড় মনিটরিংয়ের অভাব আছে। মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন। আবার এক ব্যক্তিকে একাধিক প্রকল্পের দায়িত্ব দেয়ার কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়।
বাস্তবায়নের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের পর প্রকল্পে কেনা যানবাহনগুলো সরকারি বিধি অনুসরণ করে পরিবহন পুলে জমা দেয়ার বিধান থাকলেও সেটি হচ্ছে না। নতুন নতুন প্রকল্পে নতুন করে যানবাহন ক্রয় করা হয়; যা সরকারি ও রাষ্ট্রের অর্থের অপচয়। দেখা যায়, পরামর্শক সেবার জন্য ব্যয় প্রকল্প সাহায্য থেকে করা হচ্ছে। মূলত এই খাতের ব্যয় জিওবি থেকে সংস্থান করার কথা। যেসব প্রকল্পে পরামর্শক সেবা নেয়ার প্রয়োজন নেই, সেখানে এই খাতটি বাদ দেয়ার জন্য বলেছে কমিশন।
পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, উন্নয়ন কাজে অপচয় বরদাশত করা হবে না। প্রকল্পে অর্থের অপচয় পরিহার করতে হবে। তিন বছরের প্রকল্প অথচ সময় বাড়াতেই থাকে। এটি কোনোভাবেই উচিত নয়। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে প্রকল্পে অর্থের অপচয়ের ব্যাপারে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, জুমের মাধ্যমে আমরা শিঙ্গাড়া পাঠাবো? এটা কি ভেলিড প্রশ্ন? এমন অযৌক্তিক বিষয় সাংবাদিকদের নজরে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। পার্চেজ নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন।
এম এ মান্নান বলেন, করোনায় বাসায় বসে জুম মিটিং করলেন কেন? তাতেও আপ্যায়ন ব্যয় করা লাগবে? প্রকল্পের আওতায় আপ্যায়ন ব্যয় আছে। তার মানে এই নয় যে অযৌক্তিকভাবে ব্যয় করতে হবে। প্রকল্পের আওতায় অযৌক্তিক আপ্যায়ন ব্যয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও উদ্বিগ্ন। তিনি বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আপনারা (সাংবাদিকরা) রিপোর্ট করেছেন। তবে সংশ্লিষ্ট সবাই কথা দিয়েছেন, তাদের যেসব সুযোগ-সুবিধা, আইনকানুন আছে, সেগুলো তারা প্রয়োগ করবেন।
তিনি বলেন, সব অর্থ সরকারের নয়, জনগণের। জনগণের অর্থ যদি অপচয় হয় বা বেশি করি এটি গ্রহণযোগ্য নয়। করোনা হোক বা না হোক, কোনো সময়ই জনগণের অর্থ নিয়ে নয়ছয় করা যাবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী।


আরো সংবাদ



premium cement