২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পুঁজি ভেঙে খাচ্ছে মানুষ

সঞ্চয়পত্র প্রত্যাহার বেড়েছে ৩৩ শতাংশ; চলতি ও সঞ্চয় আমানত কমে নেমেছে ৩ শতাংশে; চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে ব্যাংক খাত
-

ব্যবসায়বাণিজ্য মন্দা ও আয় কমে যাওয়ায় মানুষ ভবিষ্যতের জন্য জমানো পুঁজি ভেঙে খাচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমেছে ৭৬ শতাংশ। আর সঞ্চয়পত্র প্রত্যাহার বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। একই সাথে আয় কমে যাওয়ায় দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য জমানো চলতি ও সঞ্চয় আমানত ব্যাংক থেকে উত্তোলন করছে মানুষ। ফলে চলতি ও সঞ্চয় আমানত তলানিতে নেমে গেছে। ব্যাংকাররা আশঙ্কা করছেন, এটা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাবে। ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া অসম্ভব হবে। অনেটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে দেশের ব্যাংক খাত।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীরা দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য চলতি আমানত রাখেন। যেকোনো সময় যেকোনো প্রয়োজনে তারা ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে প্রয়োজন মেটানো হয়। আবার বাড়ি ভাড়াসহ দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর জন্য মানুষ সঞ্চয় আমানত রাখেন। এ আমানতও প্রয়োজন অনুসারে মানুষ ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে থাকেন। মানুষের আয় যখন কমে যায় তখন দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর জন্য মানুষ সঞ্চয়ী আমানত রাখতে পারেন না, বরং জমানো পুঁজিই ভেঙে ফেলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, আগের বছরের এপ্রিলের চেয়ে গত এপ্রিল চলতি ও সঞ্চয় আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় ১০ শতাংশ। সেখানে মে মাসে এসে আগের বছরের জুনের চেয়ে কমে নেমেছে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। কারো কর্মস্থল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরি হারিয়েছেন। কারো কর্মস্থল চালু থাকলেও বেতনভাতা বন্ধ রয়েছে। কারো বেতনভাতা অর্ধেকে নেমে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে মানুষ সঞ্চয় করতে পারছেন না। বরং জমানো সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকে চলতি ও সঞ্চয় আমানতে তেমন সুদ দিতে হয় না। অপর দিকে মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর পরেও মাস শেষে ৫০ শতাংশের বেশি অর্থ ব্যাংক হিসেবে জমা থাকে। ব্যাংক এসব অর্থই বাজার হারে অর্থাৎ বেশি সুদে বিনিয়োগ করে থাকে। কিন্তু বর্তমানে যে হারে সঞ্চয় ও চলতি মূলধন ভেঙে খাচ্ছে তাতে ব্যাংকের স্বল্প ব্যয়ের এ আমানত কমে যাচ্ছে। স্বল্প ব্যয়ের এ আমানত কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ স্বল্প সুদের আমানত না থাকলে মেয়াদি আমানতের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যাবে। আর এতে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাবে। এক সাথে ব্যাংকে টাকার সঙ্কট দেখা দেবে, অপর দিকে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে গেলে সরকার ঘোষিত ৯ শতাংশে সুদে ঋণ দেয়া ব্যাংকগুলোর জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে। এতে ব্যাংক উভয় সঙ্কটে পড়ে যাবে। হয় ঋণের সুদহার বাড়াতে হবে। এতে সরকারের নির্দেশনা অমান্য করা হবে, যা ব্যাংকগুলোর জন্য মোটেও সম্ভব নয়। আর এটা না করলে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে গেলে লোকসানের মুখে পড়বে। তখন আয়ের সাথে ব্যয় বেড়ে গেলে নিশ্চিত লোকসানের মুখে পড়ে যাবে। সবমিলে সামনে ব্যাংক খাতের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। কারণ ক্রেডিট কার্ড ছাড়া আর সব ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর করা হয়েছে। গত এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়ায় ঋণের গতিও শ্লথ হয়ে গেছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো আগের মতো আর ঋণ দিচ্ছে না। ঝুঁকি এড়াতে অনেকেই সরকারে দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগ করছে। অর্থাৎ সরকারকে দীর্ঘ দিনের জন্য ঋণ দেয়া হচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ তলানিতে নামার উপক্রম হয়েছে। সামনে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ আরো কমে যেতে পারে বলে ব্যাংকাররা আশঙ্কা করছেন।
এ দিকে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় সঞ্চয়পত্রও প্রত্যাহার বেড়ে গেছে। মানুষের আয় কমে যাওয়ায় প্রথমেই স্বল্প মেয়াদে সঞ্চয়ে হাত দিচ্ছে। এরপরও কুলাতে না পারায় দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ে হাত দিচ্ছে। মানুষের আয় কমে যাওয়ায় ব্যাংক থেকে আমানত প্রত্যাহার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদের সঞ্চয়েও হাত দিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিদায়ী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি যেমন কমেছে, তেমনি প্রত্যাহারের হারও বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত এক বছরে (জুন শেষে) সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে এর প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক প্রায় ৭৬ শতাংশ। যে খাতে আগের অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৪ দশমিক ২১ শতাংশ, সেখানে বিদায়ী অর্থবছরে এ বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি কমে নেমেছে ঋণাত্মক ৭৬ শতাংশ। অপর দিকে আগের বছরে সঞ্চয়পত্রে প্রত্যাহার ও পরিশোধের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যেখানে প্রায় ১৫ শতাংশ, এবার তা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে হয়েছে ৩৩ দশমিক ১৭ শতাংশে। অর্থাৎ এক দিকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমেছে, সেই সাথে বেড়েছে প্রত্যাহার ও পরিশোধ ব্যয়। এ পরিস্থিতি বেশি দিন থাকলে সরকার বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ ঋণের একটি বড় অংশ অর্থাৎ কাক্সিক্ষত হারে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়বে না। এতে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সরকারের ব্যাংক ঋণের ওপরই নির্ভরশীলতা বেড়ে যাবে। এতে বেসরকারি খাত আরো চাপে পড়ে যাবে। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেও কল্যাণ বয়ে আনবে না।


আরো সংবাদ



premium cement